রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গা জাতিগত নিধন-গণহত্যা বন্ধ করণের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান

452

মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন (আবু)- ৭ অক্টোবর ২০১৭, দৈনিক রাঙামাটি:  গত ২৫ আগষ্ট, ২০১৭ ইং তারিখ এ মিয়ানমারের রাখাইনের মুসলমান অধিষ্ঠিত এলাকার ৩০টি পুলিশ ও আর্মী চেকপোষ্টে কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসী অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১২ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। এ অপরাধে মিয়ানমারের অং সান সূচী সরকার রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপারেশন ক্লিয়ারেন্স সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। অসমর্থিত খবরে জানা যায় ইতোমধ্যে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মেইটু মনটিং বুসিং পাহাড়ের পাদদেশে মিয়ানমার সেনারা প্রায় ১২ হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা যুবককে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে একসঙ্গে হত্যা করেছে। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইঙ্গ এর নেতৃত্বে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গা জাতিগত নিধন-গণহত্যা অব্যাহত রেখেছেন, যা জার্মানীর সাবেক চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছে। হিটলার তৎকালীন ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন কায়দায় জাতীয় সম্পদ লুটপাটের মাধ্যমে অসাধ সম্পদের মালিক বনে যায় এবং যাদের কারণে জার্মানীর সাধারণ গণমানুষের অর্থনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছায় ও দৈনন্দিন জীবনমান দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান সেনাবাহিনী শুধু তাদেরকেই হত্যা করেন। পক্ষান্তরে মিন অং হ্লাইঙ্গ এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অসংখ্য মুসলিম রোহিঙ্গা যুবতী নারীদের ধর্ষণ ও হত্যা করেছে।

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করার জন্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা ২৫ আগষ্ট ২০১৭ ইং দিনের পূর্বাহ্নে প্রকাশ করার ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অপারেশন ক্লিয়ারেন্স মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর যে জাতিগত নিধন-গণহত্যা শুরু করলো তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈকি! সম্ভবতঃ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক কোন গোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দ্বারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।

ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৩০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতিদিন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আসার স্রোতে দু’দেশের সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে সবসময় হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের বাড়ী-ঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে মুসলিম রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধন-গণহত্যা করে চলেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এ সংখ্যা অচিরেই ১০/১২ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইতোপূর্বে আশ্রয়কৃত মুসলিম রোহিঙ্গাসহ বর্তমানে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে ৯ লাখের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশে তাদেরকে অন্ন, বস্ত্র, সাময়িক বাসস্থান ও চিকিৎসা দেয়া অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। শরণার্থীদের জন্য সরকার কর্তৃক যে সাহায্য দেয়া হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ থেকে ইতোমধ্যে যে ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশে এসে পৌছেছে তার পরিমাণও যথেষ্ট নয়। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, সৌদি আরব, গ্রেট বৃটেন, চীন, ভারত, তুরস্ক, ফ্রান্স, সুইডেন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়াসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণ প্রদান করতঃ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখার ঘোষণা দিয়েছে, যা রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

আমরা জানি, বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা- মানুষ হত্যা তো দূরের কথা জীবজন্তু, পশুপাখি, গাছপালা হত্যাও মহাপাপ। গণতন্ত্র ও শান্তির জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রধান ব্যক্তিত্ব অং সান সূচী শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর সরকার কিভাবে মানবতা লঙ্ঘন করে অসহায় মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালাতে পারে? অং সান সূচী ও মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইঙ্গকে অবিলম্বে রাখাইনে মুসলিম জাতিগত নিধন বন্ধ করতে হবে। অং সান সূচী মিয়ানমারের ষ্টেট কাউন্সিলর হিসেবে সম্ভবতঃ সেনাবাহিনীর চাপের মূখে রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনে-গণহত্যায় নিরব ভূমিকা পালন করছেন, যা নজিরবিহিন। তাই বলে তিনিও এ গণহত্যার দায় এড়াতে পারেন না। এ নৃশংস ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বিশ্ব স¤প্রদায়ের নিকট আমাদের প্রশ্ন মিয়ানমার সেনাবাহিনী কি কারণে নিরহ মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর এমন নৃশংস ও বর্বর হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তা খতিয়ে দেখা দরকার। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে একযোগে কাজ করতে হবে। মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘটিত মুসলিম রোহিঙ্গা জাতিগত নিধন-গণহত্যার জন্য ঘাতক মিন অং হ্লাইঙ্গ ও তাঁর সহযোগিদেরকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বে বৌদ্ধ ও মুসলিম জাতি সবসময় শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান করে আসছেন। কিন্তু এ ঘটনা সেই স্মপ্রীতি ধ্বংস করবে। যদি মিয়ানমারের সূচী সরকার ও সামরিক জান্তা প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা সকল রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে তাদের নিজ আবাসভূমি রাখাইন প্রদেশে যথাযথ সামাজিক নিরাপত্তাসহ পুনর্বাসন করতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিকমনা মুসলিম জনসাধারণ এদেশ থেকে সকল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেলে আসা আবাসভূমিতে বিতাড়িত করতে পারে। দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে শৃঙ্খলার সাথে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ তদারকীসহ রোহিঙ্গাদের সাময়িক পুনর্বাসন করা অব্যাহত রাখায় সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আপতকালীন ন্যূনতম ২ ডিভিশন সেনাসদস্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার এলাকায় মোতায়েন করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজনীয় সজাগ দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।

সম্ভবতঃ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে চিরতরে বিতাড়িত করার জন্য অত্যান্ত ঠান্ডা মাথায় তাদের ওপর ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা পরিচালনার লক্ষ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী “আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মী” নামক সংগঠনের নামে কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসী দ্বারা রাখাইনের ৩০ নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়ে ১২ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে নাটক সাঁজিয়েছে।

ইতোমধ্যে নাফ নদীতে এদেশীয় ডাকাতরা মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কয়েকটি পরিবারের মালামাল সর্বস্ব লুট করে নেয়ার পর নৌকা ডুবিয়ে ১৫ জনের অধিক রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে। এদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং এ বিশ্বের ৭ জন আন্তর্জাতিক বিচারক মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মুসলিম রোহিঙ্গা জাতিগত নিধন-গণহত্যার জন্য মিয়ানমার সরকারকে দায়ী করে মালয়শিয়ার আন্তর্জাতিক গণআদালতে যে রায় দিয়েছেন তা বিশ্ব-স¤প্রদায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বের সাথে দেখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং জাতিসংঘে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা জাতিগত নিধন-গণহত্যা বন্ধ করণসহ বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়কৃত রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নিজ ভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে মর্যাদার সাথে পুনর্বাসন করার জন্য বিশ্ব স¤প্রদায়ের নিকট ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমরা বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস (বিজেসি) এসব প্রস্তাব সমর্থন করছি। আশা করি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অভিন্ন মত পোষণ করবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংকট মোকাবিলায় বর্তমান সরকারকে ত্রাণসামগ্রী ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি এবং দেশে-বিদেশে অবস্থানরত দেশবাসীর মধ্যে যারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী তাদেরকে সবিনয় আহ্বান জানাচ্ছি। এক্ষেত্রে ইসলামী বিধান অনুযায়ী যাকাতের অর্থও প্রদান করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে তাদের আবাসভূমি রাখাইনে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করতে ব্যর্থ হলে এতদঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং জাতিসংঘের সদর দপ্তরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রাখাইনের মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক উন্মুক্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে চীন ও রাশিয়া ছাড়া সকলেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশ করায় বাংলাদেশের সমস্যার কথা বিবেচনা করে মিয়ানমারে জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল প্রেরণ ও মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধসহ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কোন কার্যকরী প্রস্তাব পাশ করতে পারেনি।

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক আইনানুসারে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ধর্মীয় সা¤প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধ্বে উঠে ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ বিশ্বনেতৃবৃন্দকে একযোগে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন, নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষা করুন।

লেখক- সভাপতি, বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস (বিজেসি) ও
জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ)

পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরো প্রধান।