সেন্টমার্টিন্স ও নিঝুম দ্বীপ- পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে শিবলুল আজম কোরেশরি সফলতা

599

exhibition-in-dhaka

৫ নভেম্বর ২০১৬: ঢাকার জয়নুল গ্যালারিতে দৈনিক রাঙামাটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কাছ থেকে পর্যটনশিল্প উন্নয়নে অবদানের জন্য সম্মাননা গ্রহণ করছেন শিবলুল আজম কোরেশী।
শামীমুল আহসান- ৫ নভেম্বর ২০১৬, দৈনিক রাঙামাটি: পারিবারিক ঐতিহ্য বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজস্ব উদ্যোগে দেশের পর্যটনশিল্প উন্নয়নে যারা সফল হয়েছেন তাদের মধ্যে টোয়াব নেতা, ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ‘অবকাশ পর্যটন লি:’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক- শিবলুল আজম কোরেশী অন্যতম। দেশের অন্যতম সামুদ্রীক সম্পদ, পর্যটন স্পট, বিশ্বখ্যাত ‘প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন্স ও নিঝুম দ্বীপ’ দেশের পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে তার ভূমিকাই বেশী। এ ক্ষেত্রে তিনি সফল। কেননা এ দুটি দ্বীপাঞ্চলে পর্যটন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনিই প্রথম। ১৯৯৬ সালে সেন্টমার্টিন্সে তার উদ্যোগে চারজনে মিলে জমিকিনে সর্ব প্রথম ব্যবসায়ীক ভাবে গড়ে তোলেন ‘সেন্টমার্টিন্স রিসোর্ট’ নামক একটি পর্যটন হোটেল কম্পেøক্র। নিঝুম দ্বীপেও তিনি সর্ব প্রথম ২০০৫ সালে  দোতলা ভবন নিয়ে গড়ে তোলেন ‘নিঝুম রিসোর্ট’।

সরকার ঘোষিত পর্যটন বর্ষের প্রাক্কালে এসে তিনি বলেন, গত ২০ বছরের পর্যটন ব্যবসায় সফলতার পাশা পাশি তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এ ব্যবসায় বিনিয়োগকৃত অর্থ তিনি এখনো ফেরত নিতে পারেননি। অফিস খরচ, কর্মচারিদের বেতন ভাতা দিয়ে কর্মকর্তা হিসেবে কোনো বেতন ভাতা আজো তিনি নেননি। অন্য সব ব্যাবসার পাশা পাশি শখ মেটানোর তাগিদেই সামলে নিচ্ছেন পর্যটন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘অবকাশ পর্যটন লিমিটেড’র জত ঝামেলা। তার মতে তড়ি ঘরি করে, কোনো প্রকার অবস্থা যাচাই না করেই সরকারের পর্যটন বর্ষ ঘোষণা পর্যটন ব্যবসায় বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলেনি। এবারও জঙ্গীবাদ ইসুতে এখন পর্যন্ত তেমন বিদেশি পর্যটক তারা পাননি।

১৯৮২ সালে শিবলুল আজম কোরেশী সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা করে ব্যার্থ হন। পরে ১৯৯৪ সালে ভ্রমণ পিপাসু দুই বন্ধু এসবি সেলিম ও রফিকুল বারীকে নিয়ে পরিবারসহ বেড়াতে যান। সে সময় সেন্টমার্টিন্স যেতে হতো দুস্বাধ্য অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে। দেশসেরা নন্দিত সাহিত্যিক, উপন্যাশিক প্রয়াত হুমায়ূন আহাম্মেদ নিয়মিত সে অভিযাত্রী ছিলেন। ১৯৯০ সনে তিনিই সেন্টমার্টিন্স দ্বীপ’র প্রধম ভিআইপি পর্যটক ছিলেন। সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের তার উপস্থিতি কোরেশীকে আরো বেশী আগ্রহী কওে তোলে। তখন টেকনাফ থেকে সপ্তাহে দুই দিন দুটি ট্রলার যাতায়াত করতো। তাও আবার পানি ছুঁই ছুঁই করে স্থানীয় যাত্রীতে ঠাসাঠাসি করা। এই অবস্থায় বিশাল জলরাশির মধ্য দিয়ে আড়াই ঘন্টার পথ ট্রলারে পারি দেয়া কি যে কঠিন তা শুধু তিনিই জানেন যিনি এ অবস্থায় ঐ পথ প্রথম পারি দিয়েছেন। আবার যদি সে পথ পারি দিতে হয় জেলে নৌকায় ?

হ্যাঁ, শিবলুল আজম কোরেশী যে দিন প্রথম সেন্টমার্টিন্স যান তার দল নিয়ে, সেদিনের সিডিউলে কোনো ট্রলার ছিলনা। সময়ের তাগিদে ঐ দিনেই তাদের সেন্টমার্টিন থেকে ফিরতে হবে। তাই তারা একটি জেলে নৌকা রিজার্ভ করে সেন্টমার্টিন্স দেখার সাধ মেটান। সে সময় সেন্টমার্টিন্সে থাকার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব বাংলো আর স্থানীয়দের বাড়ি। সেখানে সাধারণ পর্যটকরা থাকার অনুমতি পেতোনা। এ অবস্থায় শিবলুল আজম কোরেশী অনুভব করলেন এখানে ব্যবসায়ীক ভিত্তিতে একটি পর্যটন স্থাপনা গড়ে উঠতে পারে। তাই ১৯৯৬ সনে তিনি সেন্টমার্টিন্সে দুই বন্ধু এসবি সেলিম ও রফিকুল বারীসহ আরো দুইজনকে সাথে নিয়ে এক খন্ড জমি কেনেন। তার পর ৯৭ সনে সেখানে ‘সেন্টমার্টিন্স রিসোর্ট’ কম্পেøক্র’র কাজ শুরু করেন। ১৯৯৬ সনেই তারা চারজন মিলে ‘অবকাশ পর্যটন লি:’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরেই তারা নিজ উদ্যোগে প্রায় একশ’র মত পর্যটক বহন যোগ্য একটি ‘পর্যটন বোর্ড’ নির্মান করে ট্যুর অপারেটিংয়ের মাধ্যমে শীত মৌসুমে প্রতিদিন সেন্টমার্টিন্সে পর্যটক নিয়ে যেতেন। সকালে গিয়ে পর্যটকদের আবার সন্ধ্যার মধ্যে টেকনাফে ফিরে আসতে হতো। সেন্টমার্টিন্সে সে সময় বালুর উপর হাটা, নারিকেল গাছের গোড়ায় বসে তার ছায়া নেয়া, প্রবালের উপর বসাই ছিল বিশ্রাম। কালের পরিবর্তনে মাত্র বিশ বছরে সেই সেন্টমার্টিন্সে বৈধ-অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠেছে প্রায় শতাধীক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, কটেজ। খাবর হোটেল, দোকান পাট। সরকারি ও বেসরকারি ব্যংকের পুষ্ঠপোষকতায় পর্যটকদের যায়াতের নিশ্চয়তা সরূপ সরকার নিয়ত্রীত ব্যবস্থায় চালু করা হয়েছে সমুদ্রগামী জাহাজ সার্ভিস। জাহাজ ঘাটসহ তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তা।

১৯৯৮ সনে ‘সেন্টমার্টিন্স রিসোর্টে’ পর্যটকদের বুকিং দেয়া শুরু করেন। বর্তমানে ‘সেন্টমার্টিন্স রিসোর্ট’টি তিন তলা ভবন বিশিষ্ট। এখানে বিভিন্ন ক্যাটাগড়িতে ভিআইপি ও সাধারণ মিলে একত্রে ১১১জন পর্যটক থাকতে পারছেন। জেনারেটর ও সোলার পদ্ধ্যতির মাধ্যমে গ্রাহকদের বৈদ্যতিক সুবিধা দেয়া হয়। ভাড়াও খুব একটা বেশী নয়। জন প্রতি ৪০০/- টাকা থেকে ৮০০/- টাকার মধ্যে এখানে থাকা যাবে। খাবার ব্যবস্থাও সুলভ। সামুদ্রীক মাছ, মোরগ/মুরগি, ডিম ও সবজির সমন্নয়ে অল্প খরচে খাবার সরবারহ করা হয়। ‘সেন্টমার্টিন্স রিসোর্ট’ এ যেতে ষ্টীমার ঘাট থেকে পাকা রাস্তা ধরে এক কিলো মিটার পথ অতিক্রম করতে হবে।

সেন্টমার্টিন্স রিসোর্ট এর সফলতার পর ২০০৫ সনে তিনি নিঝুম দ্বীপে ব্যবসা শুরু করেন। এখানেও বিভিন্ন ক্যাটাগড়িতে ভিআইপি ও সাধারণ মিলে একত্রে ৪৫জন পর্যটক থাকতে পারছেন। জেনারেটর ও সোলার পদ্ধ্যতির মাধ্যমে গ্রাহকদের বৈদ্যতিক সুবিধা দেয়া হয়। ভাড়া অনেক কম। জন প্রতি ৩০০/- টাকা থেকে ১২০০/- টাকার মধ্যে এখানে থাকা যাবে। খাবার ব্যবস্থাও সুলভ। সামুদ্রীক মাছ, মোরগ/মুরগি, ডিম ও সবজির সমন্নয়ে অল্প খরচে খাবার সরবারহ করা হয়। শুধু শীতের মৌসুমে নয়, আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে নোয়াখালির হাতিয়া উপজেলার কমর উদ্দিন ঘাট হয়ে সারাবছর পর্যটকরা এ অঞ্চলের প্রকৃতি উপভোগ করতে পারবেন।
দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বেশ কয়েকটি সংগঠন ও সংস্থা থেকে তাকে সম্মাননা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে,  তার মধ্যে মানবাধিকার জোট, ইউনাইটেড মূভমেন্ট হিউম্যন রাইটস, কাগজ কলম বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেমন ও দৈনিক রাঙামাটি ।

ব্যবসার পাশা পশি শিবলুল আজম কোরেশী একজন ভালো সংগঠ। ১৯৯৯ সনে তিনি পর্যটনশিল্প ব্যবসায়ীদের সংগঠন টোয়াবের সদস্য হন। ২০০১-৬ সাল পর্যন্ত কর্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন। ২০০৮-৯ সালে তিনি এ সংগঠনের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৯-১৩ সালে তিনি সংগঠনটির পরিচালক নির্বাচিত হন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬’র জুন মাস পর্যন্ত সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন। বর্তমানে তিনি এ সংগঠনের পরিচালকের দায়ীত্ব পালন করছেন।

শিবলুল আজম কোরেশী পর্যটন ব্যবসায় নিজে আর্থিক ভাবে সফলতা না পেলোও সেন্টমার্টিন্স ও নিঝুম দ্বীপের সাধারণ মানুষের আর্থিক সাবলম্বিতা তার নিজের সফলতা মনে করছেন। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের আগে সেন্টমার্টিন্স ও নিঝুম দ্বীপের মানুষ দারিদ্রতার চরমে অবস্থান করতেন। আমাদের ব্যবসায়ীক দৃষ্টির ফলে সেখানে চরম দরিদ্র মানুষ, যারা আজ একটা কিছু করে সংসার চালাতে পারছেন। সেন্টমার্টিন্সে রাস্তা-ঘাট, হাসপালাত যা কিছু হয়েছে সব ১৯৯৬ সালের পরে হয়েছে। আমরা খোলা মাঠে একখানা ভ্যান গাড়ী দিয়ে ব্যবসা শুরু করে ছিলাম। এখন সেখানে আলিশান হোটেল, মোটেল, কটেজের পাশ পাশি পাকা রাস্তা হয়েছে। তাদের উৎপাদিত ফসল- চাল, সবজি-তরকারি, নরিকেল, কলা, পেপে ও জেলেদের শিকার করা মাছ এখন সেখানেই চড়া মূল্যে বিক্রি করে তারা আর্থিক সুবিধ পাচ্ছেন। পাশা পাশি পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে শিক্ষারও বিকাশ ঘটেছে। ১৯৯৬ সালে সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে একজন মাত্র মেট্টিক পাশ ছিলেন। এখন সেখানকার অনেকেই বিশ্ব বিদ্যালয় পড়া লেখা করছেন। সাইবার প্রভাবও পরছে তাদের মধ্যে। এ সব হয়েছে পর্যটকদের উপস্থিতির কারনে। আমরা সেখানে শুধু পর্যটকদের উপস্থিত করেছি।

নিঝুম দীপেও তাই। সেখানে আমরা কোনো স্থাপনা না করেলেও পর্যটকদের নিয়ে আমাদের উস্থিতি সেখানকার মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। এইসবই আমার সফলতা। এতেই আমি তৃপ্ত।

পোস্ট করা হয়েছে- ঢাকা ব্যুরো অফিস থেকে।