আমাদের প্রিয় স্বাধীনতাঃ এগিয়ে চলার অর্ধশতাব্দী

625

॥ আনোয়ার আল হক ॥
প্রত্যেক জাতীর আশা-আকাঙ্খাক্ষার মূর্ত প্রতীক তার স্বাধীনতা। কারণ, স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। কিন্তু যুগ-যুগ ধরে বাঙালি জাতি পরাধীন ছিল। পরাধীন শাসনে বাঙালি জাতি হয়েছে নিষ্পেষিত। বিভিন্ন শ্রেণির শাসকগোষ্ঠী এ বঙ্গীয় নামের জনপদ শাসন-শোষণ করেছে। কিন্তু কারো কাছে মাথা নত করে থাকা বাঙালির স্বভাব নয়। তাই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে অতীতে আমাদের বীর সন্তানেরা লড়াই করেছে; সংগ্রাম করেছে প্রিয় স্বাধীনতার জন্য।

১৭৫৭ সালে বৃটিশ বেনিয়ারা যখন এই বাংলার শাসন ক্ষমতায় জেঁকে বসে; তার পর থেকেই বাঙালি জাতি তাদের হারানো স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াই শুরু করে, কখনও প্রত্যক্ষ এবং কখনও পরোক্ষভাবে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মের মাধ্যমে এই অর্জনের পথে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর নতুন করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নানা দুর্নীতি, শাসন-শোষণ এবং নির্যাতনের কবলে পড়ে বাঙালিরা। আবারও শুরু হয় প্রতিবাদ সংগ্রাম। এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বাঙালি অনেক ছাত্র নেতা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পাক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে জেলজুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছে। অবশেষে চুড়ান্তভাবে ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পাই একটি স্বাধীন দেশ স্বাধীন পতাকা, যার নাম বাংলাদেশ।

একাত্তর সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি গহণের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী যাদুকরি ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতি শারিরিক মানষিক এবং সামাজিকভাবে সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্ততি নিতে থাকে। নানা টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে দুই সপ্তাহ পার হলেও ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের চুড়ান্ত নির্দেশ দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন জাতীর এই গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিংসবাদিত নেতা। মূলত তার নেতৃত্বেই বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে; আর তিনি বঙ্গবন্ধু থেকে জাতীর পিতা অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকলেও পরবর্তী ৯ মাস তারই আদর্শিক নেতৃত্বে বীর বাঙালি যুদ্ধ করে। ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা পায়।

স্বাধীনতা মানে আত্মমর্যাদা। আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা। সব ধরনের অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের বিপরীতে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সুষম বণ্টন, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। এগুলোই আমাদের আত্মমর্যাদা ও একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একটি স্বাধীন জাতী আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, পরাধীন জাতীর কখনো আত্মমর্যাদা থাকে না।

ইতোমধ্যে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো, আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই অর্ধশতাব্দীতে আমাদের অর্জন মোটেও কম নয়। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে শূণ্য থেকে শুরু করা যে দেশের আজ আমরা সুবর্ণ জয়ন্তি আমরা যখন পালন করতে যাচ্ছি, তখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরে এই সুপারিশ জাতিকে আরো উচ্ছ্বসিত করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই প্রাপ্তি বিরাট অর্জন।

কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, তথ্য প্রযুক্তি, নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নসহ মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে। শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন আর মঙ্গাপীড়িত দেশ বা তলাবিহীন ঝুড়ি নয়; বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাসীর কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। ইতোমধ্যে আমরা নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। এখন আমাদের বলা হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ। স্বাধীনতা যেমন আমাদের গর্বের সেই স্বাধীনতার পথ ধরে আমাদের এই অর্থনৈতিক মুক্তি বা উন্নতিও আর একটি শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে সমাদৃত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পোশাকশিল্প বাংলাদেশের ভাগ্যের দুয়ার খুলে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরাও দায়িত্ব পালন বা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থেকে আমাদের অভ্যন্তরীন অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃত্তি অর্জনের পথে বাংলাদেশ। ১১ লক্ষ বিতাড়িত রোহিঙ্গ নাগরিককে আশ্রয় দেওয়ার পর তাদের সফল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে মানবতার এক কালজয়ী নজির স্থাপন করেছে। সমুদ্র বিজয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে বড়-বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য দৃশ্যমান। মূলত আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজন অবশ্যই সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ব্যবস্থা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এমডিজি বা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল এর সব কটি সূচকে সাফল্য প্রদর্শনের পাশাপাশি এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার অভিযাত্রাও চমৎকারভাবে সাফল্য দেখিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন সার্বভোম বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। আমাদের রয়েছে, পৃথিবীর সেরা উর্বর মাটি, যে মাটিতে সোনা ফলে। সুজলা-সুফলা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। তাই যুগে-যুগে হায়েনারা এ কারণেই বাংলাকে তাদের নিজেদের অধিকারে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের উর্বর মাটির উপরের অংশে একদিকে সোনা ফলে তথা বিচিত্র ফসলের সমাহার অন্যদিকে মাটির নিচে রয়েছে তেল, গ্যাস, কয়লাসহ নানা ধরনের খনিজসম্পদ। রয়েছে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গর্বিত সেনাবাহিনী। মুসা ইব্রাহিম, নিশাত মজুমদারের মতো গর্বিত ছেলে-মেয়েরা হিমালয়ের পর্বত চূড়ায় আরোহণ করে অজয়কে জয় করে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে বীরত্ব ও গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছে এই দেশের। তাই বাংলাদেশ কোনো দিক থেকে আর পিছিয়ে নেই। উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু তবুও কিছু সমস্যা রয়েছে। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি আমাদের উন্নতির পথে প্রধান শত্রু। সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্ত চক্র লুটেরা আমাদের অর্থনীতির গতিকে মন্থর করছে। তাই দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমতাভিত্তিক সমাজ। প্রান্তিক চাষি, হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কেননা বাংলাদেশ নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও এখনো দরিদ্র মানুষের সংখ্যা রয়ে গিয়েছে। এই সংখ্যাকে শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। আর বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থেই একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। একাত্তরে লাখো শহীদের স্বপ্ন একটি উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন পূরণে সরকারের পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতিকে অবশ্যই জনকল্যাণমুখী হতে হবে। তাহলে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের ভাগ্যের পারিবর্তন ঘটবে। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে ১৬ কোটি মানুষ।

স্বাধীনতার এই মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে। এ বছর জাতি এই কালজয়ী নেতার একশ’ একতম জন্মবার্ষিকী ঘিরে পালন করছে; রয়েছে মুজিব শতবর্ষের রেশ। স্মরণ করি বীর মুক্তিযোদ্ধা, অসংখ্য ত্যাগী মা-বোন ও লাখো শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি ও প্রিয় স্বাধীনতা।