॥ মোঃ নুর জামাল ॥
২০১৬ সালে কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করার পরবর্তী মাসেই এসএসসি পরীক্ষা ছিল। আমি নতুন শিক্ষক হিসেবে পরীক্ষায় হল পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো সমস্যার সম্মূখীন হলে সবচেয়ে বেশী সহযোগীতা পেতাম জসিম উদ্দিন মজুমদার স্যারের নিকট থেকে। পুরো সময় আমি তাঁকে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। একজন সহকর্মী হিসেবে কাছের বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী হয়ে পাশে ছিলেন। যার কাছে আমি শিক্ষক জীবনে ঋণী।
জসিম উদ্দিন মজুমদার স্যার গত ৭ আগষ্ট ২০২২ বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে চট্টগ্রামের সার্জিস্কোপ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মহান রবের নিকট হাজির হয়েছেন। যিনি নিয়মিত সময়ানুযায়ী বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে শিখন কার্যক্রমে উপস্থিত থাকতেন, বিধাতার নির্ধারিত সময়েই তিনি পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। কাঁদিয়ে গেছেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ শীষ্য ও ভক্তকে। জসিম উদ্দিন মজুমদার স্যার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছরে ৫ জুলাই কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার মড়হ গ্রামের মজুমদার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় বাবা ওয়াজিউল্লাহ মজুমদারকে হারান। নিজের অদম্য ইচ্ছাকে বাস্তবায়নে লক্ষণপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে মাধ্যমিক পরিক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ৯১ এ ¯œাতক ও ৯৯ এ শিক্ষায় ডিগ্রি নেন। ১৯৯৫ সালের ২৯ জুন প্রথম কর্মস্থল হিসেবে পার্বত্য এলাকার ঐতিহ্যবাহী কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মাত্র ১৭২৫ টাকা বেতনে যোগদান করেন। সেই পথ চলা শুরু। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে দীর্ঘ ২৬ বছর ১ মাস ৯ দিনে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে দীক্ষা দিয়ে গেছেন। কর্মজীবনে সফল এই মানুষটি তাঁর প্রতিটি দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের নিকট একজন আদর্শ শিক্ষক, সংগঠক ও পরিবারের কর্তা হিসেবে আদর্শ স্বামী কিংবা বাবা। তাঁর প্রতিটি কর্মে রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যেত।
মজুমদার স্যার নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন ও খবরা-খবরে আপডেট থাকতেন। সাদা মনের মানুষ হিসেবে সবসময় বিভিন্ন তথ্য আমাদের সাথে শেয়ার করতেন। তিনি একজন মুসলিম হিসেবে ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধানসমূহ মেনে চলার চেষ্টা করতেন। মসজিদে সবসময় প্রথম কাতারে উপস্থিত থাকতেন। করোনা অতিমারিতেও তিনি মসজিদে পাঁচজন মুসল্লীর একজন ছিলেন। সমাজের সর্বস্তরে তাঁর পদচারণা বিরাজমান ছিল। সবসময় ন্যায়ের পথে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন। নিজের সমস্যাগুলোকে কখনো কারো সাথে শেয়ার করতে চাইতেন না। অন্যের বিপদে বা সমস্যায় সব সময় এগিয়ে আসতেন। মহান আল্লাহর ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। এইজন্য নিজের দুরারোগ্য ব্যাধিকেও পাত্তা দেননি। ৭-৮ বছর আগে রোগ দেখা দিলে চিকিৎসা করতে থাকেন। চিকিৎসকের পরামর্শমতো জীবন পরিচালনা করেন। এরপরও ধীরে ধীরে আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু পরিবার বা সহকর্মী কাউকে তা বুঝতে দেননি। অবস্থা খারাপ হলে পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করান। সবশেষে ধরা পড়ে মরণব্যাধি ক্যান্সার। এই ক্যান্সারে পরাজিত হয়ে মজুমদার স্যার পরপারে পাড়ি জমান। সাথে প্রশ্ন রেখে যান দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপারে। পূর্বেই যদি রোগ নির্ণয় করা যেত তাহলে হয়ত ফলাফল ভিন্নও হতে পারতো। সর্বোপরি ভাগ্যের কাছে সপে দিয়ে গেছেন স্ত্রী, এক পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানকে। পুত্র মুনতাসির মাহমুদ রাকিব ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বড় মেয়ে জায়মা জাহান তানজু আমেরিকা প্রবাসী, মেঝ মেয়ে তাহিরা জাহান বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ কাপ্তাইয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও কনিষ্ঠ কন্যা উম্মে আয়মান আল-আমিন নুরিয়া মাদরাসায় ১ম শ্রেনিতে অধ্যয়নরত। আমরা জসিম উদ্দিন মজুমদারের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করুন। [লেখকঃ সহকারী শিক্ষক, কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয়, কাপ্তাই, রাঙামাটি।]