এক প্রহসনের নাম ‘ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা দিবস’

622

FILFSTIN DR

আনোয়ার আল হক- সম্পাদকের কলাম, ৩০ নভেম্বর ২০১৫, দৈনিক রাঙামাটি : গতকাল ২৯ নভেম্বর ছিল ‘ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা দিবস’ তথা ওহঃবৎহধঃরড়হধষ উধু ড়ভ ঝড়ষরফধৎরঃু রিঃয ঃযব চধষবংঃরহরধহ চবড়ঢ়ষব ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বব্যপী জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটি পালন করা হয়। ফিলিস্তিনি জনগণের আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন এবং সহমর্মিতা প্রর্শনের জন্য এই দিবসটির প্রচলন করে জাতিসংঘ। ১৯৭৭ সালের ২ ডিসেম্বর গৃহীত জাতিসংঘের কার্য বিবরণী ৩২/৪০ এবং ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর গৃহীত সংযোজনী কার্যবিবরণী ৩৪/৬৫ অনুযায়ী এই দিবসটি সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, আমরা বছরে শতাধিক আন্তর্জাতিক দিবস পালন করি। আর এর প্রায় প্রতিটি দিবসই অনেক ঘটা করে পালন করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। অথচ এই আন্তর্জাতিক দিবসটি অনেকটা নিরবেই পেরিয়ে গেলো; শুধুমাত্র জাতিসংঘ সদর দপ্তর ছাড়া গতকাল কোথাও তেমন কোনো কর্মসূচিও চোখে পড়েনি। কেউ দিবসটি পালন করে থাকলেও তা ছিল একেবারে নিরব ও নিরুত্তাপ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। আরো আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, ওয়েব জগতেও এ নিয়ে তেমন কোনো লেখা-যোখা চোখে পড়লো না। ইন্টারনেটে আতিপাতি করে খুঁজেও ফিলিস্তিনি মানবতার জন্য গোটা কয়েক কবিতা ছাড়া আর তেমন কিছুই পাওয়া গেলো না। দিবসটি সম্পর্কে শুধুমাত্র সরকারি গুটি কয়েক কর্মকর্তা ছাড়া আর কারো জানা আছে বলেও মনে হলো না। তাই এ বিষয়ে দু’কলম লেখার গরজ অনুভব করলাম।
আমরা সকলেই জানি যে, প্রায় ৬৭ বছর ধরে ফিলিস্তিনের মানুষ, নিজেদের ভিটেমাটি ও স্বাধীন ভূখন্ডের জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। দখলদার রাস্ট্র ইজরায়েল, সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ক্ষেত্র বিশেষে ইংল্যান্ডসহ তাদের কয়েকটি আজ্ঞাবহ দেশ ব্যতিত সমগ্র বিশ্ব মানবতা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেও বিগত ৬৭ বছরে এই মজলুমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা তো করতে পারেইনি বরং বারে বারে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবতা। ইজরায়েলের এই আগ্রাসী মানসিকতার পরিবর্তনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপ বৃদ্ধি এবং মানবতার পক্ষে কথা বলার একটি স্বীকৃত পথ বের করার জন্যেই আশির দশকের জাতিসংঘ নেতৃবৃন্দ বিশ্বজুড়ে এমন একটি দিবস পালনের গরজ অনুভব করেন। আর এই দিবস পালনের জন্য ২৯ নভেম্বর দিনটি বেছে নেওয়ার তাৎপর্য হলো, এই দিনটিই সেই দিন, যেদিন ফিলিস্তিনের জনগণ নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের এই দিনটিতেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গৃহীত এক রেজুলেশন বলে একটি দেশ ভেঙ্গে দু’টি দেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অন্যকথায় বলতে গেলে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে গৃহীত হয় তথাকথিত ‘পার্টিশন রেজুলেশন’। যার বদৌলতে একই ভূমিতে সৃষ্টি হয় দু’টি রাষ্ট্র, যার একটিকে বলা হয় আরব রাষ্ট্র তথা ফিলিস্তিন, অপরটিকে বলা হয় ইহুদী রাষ্ট্র তথা ইজরাইল। কিন্তু ওই রেজুলেশন বলে তাৎক্ষণিকভাবে ইজরাইল গায়ের জোরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেও বিগত ৬৭ বছরেও ফিলিস্তিন তাদের অপহৃত অধিকার ফিরে পায়নি। সেটেলার ইজরাইল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি রাভ করলেও নিজেদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় মরণপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের মানুষ। ইতোমধ্যে যুদ্ধের মাঝেই তাদের অন্তত তিনটি প্রজন্ম শেষ হয়ে গেছে।
আজকের দিনে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জাতিসংঘ থেকে বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিনের জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য এই দিবসটি হবে আন্তর্জাতিক মহলের সচেতন হবার দিন। সাথে সাথে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর অমিংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মতামত প্রকাশের দিন এবং ফিলিস্তিনের জনগণের উপর বহিরাগত হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার দিন। জাতিসংঘ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি কমিটিও গঠন করেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘এক্সারসাইজ কমিটি’। এই কমিটির কাজ হবে নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনি মানুষদের তার জায়গায় পুণর্বহাল করা এবং তাদের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা। সাধারণত এই দিনদিতে নিউ ইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এ উপলক্ষ্যে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। যেখানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারী জেনারেল, নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিসহ সংশ্লিষ্ট আন্তঃসম্পর্ক বিভাগের কমিটি প্রধানগণ, ফিলিস্তিন ও ইজরাইলের প্রতিনিধি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত থাকেন। সেখানে সাধারণ পরিষদ প্রেসিডেন্টের একটি বিবৃতি পাঠ করা হয়, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের পাশাপাশি জাতিসংঘের সহায়তায় বিশ্বজুড়ে র‌্যালী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং বিশেষ বুলেটিন বের করা হয়। জেনেভা ভিয়েনাসহ অন্যান্য দেশগুলিতে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে এই আয়োজনগুলো করার বিষয়ে জাতিসংঘ সহায়তা করে থাকে।
প্রনিধানযোগ্য যে, সম্প্রতি জাতিসংঘ থেকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যা ফিলিস্তিনের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃত থাকার পথে মাইলফল হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। পদক্ষেপটি হলো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পতাকা উড্ডয়ন। এই বছরের পহেলা অক্টোবর থেকে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অন্যান্য দেশের পতাকার সাথে এখন স্বাধীন ফিলিস্তিনের পতাকাও উড়ছে। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি পতাকা উড়ছে। পতাকা উড্ডয়ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবার সময় ফিলিস্তিনের নেতা মাহমুদ আব্বাস ইসরাইলের উদ্দেশ্যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ১৯৯৩ সালে ইসরাঈলের সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে তার শর্ত অনুযায়ী ইসরাঈল তাদের বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ না করা পর্যন্ত এবং বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিন আর একা চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ করবে না।
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে  পতাকা উড্ডয়ন বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে পড়ে ১১৯টি ভোট, আর বিপক্ষে ভোট দেয় ইজরাঈল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট আটটি দেশ। ভোট প্রদানে বিরত থাকে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশসহ মোট ৪৫টি দেশ। অধিবেশনে একে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ফিলিস্তিনের আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া বলে অভিহিত করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের দূত রিয়াদ মানসুর। তবে এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
একটি বিষয় দ্রুব সত্য যে, সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে মানবতা এবং মমত্ববোধ আরো বাড়ছে। নতুন প্রজন্ম আজ মানুষের অধিকারের বিষয়ে খুবই সচেতন এবং সোচ্চার। নতুন প্রজন্মের জানার জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ্ব মানচিত্রে একসময় ইজরাইল নামক কোনো রাষ্ট্রই ছিল না। আর ইজরাইল নাম দিয়ে গড়ে তোলা ভূখন্ডে যারা বসবাস করছে তারা কেউই ইতোপূর্বে ওই এলাকার অধিবাসীও ছিল না। ৪৭ এ দু’টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ইউএন সিদ্ধান্ত থাকলেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ও মার্কিন মদদে ইসরায়েল নামক এই কৃত্রিম রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রিটিশ কলোনি জর্ডানকে জর্ডান নদী বরাবর দুভাগে ভাগ করে নদীর পূর্ব দিকের অংশ নিয়ে গঠিত হয় বর্তমান জর্ডান আর পশ্চিমের অংশটি ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন। কলমের এক খোঁচায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করে তৈরি করা হয় নতুন দেশ ইজরাইল। ইউরোপসহ সারা বিশ্ব থেকে দলে দলে ইহুদিদের এনে বসতি স্থাপন করা হয়। সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা ইজরাইলের আয়তন আজ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার। উগ্র ইহুদিবাদীরা এ এলাকা স¤প্রসারণ করতে এমন কোনো কাজ নেই, যা করেনি। হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লাখ লাখ আরবকে উদ্বাস্তু করে গড়ে উঠেছে এ ইজরাইল রাষ্ট্রটি। তবে যখন নিপীড়ন নির্যাতন জীবনকে নরক বানিয়ে তোলে, তখন মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে জীবনের মূল্যে।  নিজভূমে পরবাসী ফিলিস্তিনিরাও কখনই এ অন্যায় মেনে নেয়নি। স্বপ্নের স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজেদের পায়ের নিচে এক খণ্ড মাটি, উদ্বাস্তু নয় দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় আর মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনিরা লড়ছে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে।
একথা অনস্বিকার্য যে আমেরিকার সহায়তায় ইসরাইল বর্তমানে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালি রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসরাইলের বিলুপ্তি সম্ভব নয়। তাই জাতিসংঘের রেজুলেশন ১৮১ তে উল্লেখিত ভূমির মধ্যে অন্তত যেটুকু ফিলিস্তিনিদের দখলে রয়েছে তা নিয়ে হলেও আপাতত যেন ফিলিস্তিন স্বাধীন হতে পারে সে বিষয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সোচ্চার হওয়ার এখনি সময়। তবেই জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা দিবস পালন তাৎপর্যময় হবে।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক রাঙামাটি ও
সাধারণ সম্পাদক, রাঙামাটি প্রেসক্লাব

পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরোপ্রধান