করোনা পরিস্থিতিতে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম

417

॥ ইকবাল হোসেন ॥
চীনের উহান শহরে জন্ম নেয়া নোভেল করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯) সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরপরই দেশের মানুষকে এই ভাইরাসের মরণ থাবা থেকে রক্ষা করতে সরকারের নির্দেশে গত ২৬শে মার্চ হতে সারাদেশে ন্যায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতেও চলছে অঘোষিত লকডাউন। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক শুরু থেকেই রাঙামাটির জেলার প্রশাসন জেলায় করোনা ভাইরাসের সংক্রামণ রুখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

গত ২৬শে মার্চ হতে বাজারদর স্বাভাবিক রাখা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাঙামাটি জেলা শহরের বনরুপা, রিজার্ভ বাজার ও তবলছড়ি বাজার সহ প্রত্যেকটি অলিগলিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে নিয়মিত জেলা প্রশাসকের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও শহরের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চলছে পুলিশের কঠোর নজরদারি। এর ফলশ্রুতিতে বাজার দর স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি স্থানীয়দের করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানান দিয়ে ঘরে রাখতে পারা সহ দেশের ৬৩টি জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হলেও অঘোষিত লকডাউনের ৪১দিন পর্যন্ত রাঙামাটি জেলাকে করোনা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে জেলা প্রশাসন।

এদিকে অঘোষিত লকডাউনের ফলে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের জন্য সরকারি ত্রাণ পৌরসভার মাধ্যমে বিতরণ করার পাশাপাশি জেলা প্রশাসক, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সহ অন্যান্যরাও অসহায় মানুষদের ত্রাণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

মোবাইল কোর্টঃ রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদের নেতৃত্বে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সমন্বয়ে জেলা প্রশাসকের মোবাইল কোর্ট টিম সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাঙামাটি জেলা শহর ও উপজেলায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তারা প্রত্যেকটি বাজারে নিয়মিত বাজার দর মনিটরিং করছে পন্যর দাম বৃদ্ধি করলে বা মূল্য তালিকা না রেখে অতিরিক্ত দামে পন্য বিক্রয় করলে অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকা ও অলিগলিতে গিয়ে সচেতনতামূলক মাইকিং করছে মোবাইল কোর্ট টিম।

জেলা প্রশাসকঃ রাঙামাটির জেলা প্রশাসক সেনাবাহিনী পুলিশ সহ সকলের সহযোগিতায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটিকে করোনা মুক্ত রাখতে ও জনগনকে সচেতন করে ঘরে রাখার জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তিনি সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহায়তায় জেলায় প্রবেশের একমাত্র পথটিতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যার ফলে বিশেষ অনুমতি ছাড়া কেউ রাঙামাটিতে ঢুকতে পারেনি। আর যারাই এসেছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগীতা নিয়ে সবার হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত তো করেছেনই এর পাশাপাশি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষদের উপর নিয়মিত নজরদারি জোরদার করেছেন। যারা বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন তালিকা অনুযায়ী সকলে খুঁজে বের করে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছেন। তার এই তীক্ষè নজরদারির ফলে অঘোষিত লকডাউনের ৪১দিন পর্যন্ত ৬৩ জেলায় করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হলেও একমাত্র রাঙামাটি করোনা মুক্ত ছিলো। বর্তমানে রাঙামাটিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও জেলা প্রশাসকের সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে এই পার্বত্য জেলায় এখন পর্যন্ত করোনার ছোবলে কেউ প্রাণ হারায়নি।

অপরদিকে অঘোষিত লকডাউনের শুরু থেকে কর্মহীন মানুষদের সহযোগিতা করে আসছে। পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সরকারি ত্রাণ বিতরণ সহ  নিজে পায়ে হেঁটে কখনও দিনে কখনও রাতের আঁধারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে দূর্গম পাহাড় ডিঙ্গিয়ে কর্মহীন অসহায়দের ঘরে ঘরে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। এর পাশাপাশি যেসকল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা অভুক্ত থাকা সত্ত্বেও চক্ষু লজ্জার কারণে কারো কাছে হাত পাততে পারছেনা সেসকল পরিবারদের জন্য অভিনব কায়দায় অনলাইন আবেদনের প্রেক্ষিতে আবেদনকারীদের বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন ডিসি। এসব কার্যক্রমের সাথে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিজ অবস্থান থেকে রাঙামাটি বাসীর জন্য এই করোনা দূর্যোগ মোকাবেলায় চেষ্টার কোন কমতি রাখেননি ডিসি মামুন।

সেনাবাহিনীঃ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটির দূর্গম এলাকায় জনস্বার্থে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ২০১৭ সালে ঘটে যাওয়া পাহাড় ধ্বসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কার্যক্রম ছিলো চোখে পড়ার মতো। সারাদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী করোনা দূর্যোগ মোকাবেলায় বেশকিছু অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাঙামাটিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর স্থানীয়দের সচেতন করতে বিভিন্ন কার্যক্রম তারা হাতে নিয়েছে। তারা মাস্ক বিতরণ বিভিন্ন এলাকায় হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন করে সাধারন মানুষদের হাত ধোঁতে আগ্রহী করেছেন। অঘোষিত লকডাউনের পর জেলা প্রশাসকের সাথে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, জেলার প্রবেশপথে কড়া নজরদারির পাশাপাশি বেশকিছু ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে।

দেশের এই সূর্য সৈনিকরা নিজেদের রেশন বাঁচিয়ে দূর্গম পাহাড় ডিঙ্গিয়ে নিজেরা ত্রাণ সামগ্রী বহন করে অসহায়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। জনসাধারণকে সচেতন করতে নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তারা সকলে সচেতন করার কাজ করছে। লকডাউনের ফলে গাড়িতে করে হাসপাতালে প্রসব ব্যাথায় কাতরাতে থাকা পাহাড়ি নারীকে নিজেরা হাসপাতাল পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় সেনাবাহিনী কর্মহীন হতদরিদ্রদের জন্য ১মিনিটের বাজার পরিচালনা করছে। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত ১মিনিটের বাজার থেকে অসহায় দরিদ্রদের জন্য ঈদ সামগ্রী বিনামূল্য প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।

বাংলাদেশ পুলিশঃ রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় শুরু থেকে জেলা প্রশাসকের সকল কার্যক্রমে অংশ নেয়ার পাশাপাশি জেলা উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তারা যেকল যানবাহন ও মানুষ উপযুক্ত কারন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে তাদের বিভিন্ন অভিনব পন্থায় শাস্তির ব্যবস্থা করছেন। পুলিশ সদস্যদের দিয়ে মোবাইল টিম দিয়ে এলাকায় এলাকায় গিয়ে করোনা সচেতনতা মূলক মাইকিং করে যাচ্ছে। তারা যাদের বাসায় খাবার নেই কিন্তু লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারছেনা এমন পরিবার গুলোকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জেলা পুলিশের ফেসবুক আইডি ও ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করলে বাসায় খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ প্রয়োজন তাদের সুধুমাত্র একটি ফোন কল দিয়ে সমস্যার কথা জানানো মাত্র জেলা পুলিশের সদস্যরা তাদের বাড়িতে শিক্ষা উপকরণ পৌঁছে দিচ্ছে।

সর্বোপরি প্রশাসনের সার্বিক তৎপরতার কারণে রাঙামাটি জেলা ৪১দিন পর্যন্ত সকল জেলার থেকে এগিয়ে করোনামুক্ত ছিলো। এখন পর্যন্ত জেলায় কেউ এই মরন ঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেনি এবং সংক্রামণ অন্যান্য জেলার মতো দ্রুত বৃদ্ধি পায়নি।