কাপ্তাই প্রতিনিধি
সত্তরোর্ধ্ব স্বামী সন্তান হারা অন্ধ লক্ষী রানী দে। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতালের বারান্দায় গত ১২ বছর ধরে তিনি বসবাস করে আসছে। কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা কিংবা উৎসব পার্বন কখন যে চলে যায়, তার জীবনে এসবের কোন কিছু আসে যায় না। প্রতিদিন একবেলা বা দু’বেলা ভাত তরকারি পেলেই তার দিন চলে যায়। জীবনের সুখের বসন্ত কি লক্ষী রানী দে’র গত ২৮ বছরেও একবার আসেনি।
চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালের বারান্দায় কথা হয় লক্ষী রানী দে’র সাথে। তিনি জানান,রাঙামাটির রাজবাড়ি এলাকায় তার বাবার বাড়ী। তার বাবার নাম ক্ষিতিশ বিশ্বাস। কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে তাদের পৈতিক বাড়ী কাপ্তাই হ্রদে তলিয়ে যাবার পর স্বাধীনতার আগে তারা স্ব-পরিবারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনায় হিন্দু পাড়ায় মামার বাড়ীতে চলে আসে। সেখান থেকে তার বিয়ে হয় রাউজান উপজেলার উনসত্তর পাড়া গ্রামের মানিক চন্দ্র দে’র সাথে। সুখেই চলছিল তাদের জীবন। স্বামী কৃষি কাজ করে সংসার চালাতো। এরইমধ্যে তার দুই সন্তান প্রথিবীতে ভুমিষ্ট হয়। কিন্তু সবার কপালে কি সুখ আর সয়। তার প্রথম সন্তান লিটু দে মাত্র ১৩ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যধিতে মারা যায় পাহাড়তলির শশুড় বাড়ীতে। তার বড় ছেলে লিটু মারা যাবার পর ৬ বছর পর আর এক ছেলে সুজয় দে মাত্র ১১ বছর বয়সে সেখানে মারা যায়। ছেলে হারা লক্ষী রানীর জীবন যেন এক বিভীষিকায় পরিণত হয়।
কথায় আছে “মরার উপর খাড়ার ঘা”। ছেলে হারানোর ৮ বছর পর পুত্রশোক সইতে না পেরে লক্ষী রানী দে’র স্বামী মানিক চন্দ্র দে সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায়। স্বামী মারা যাবার পর তার জীবনে নেমে এসে আরো চরম দূর্বিষময় দিন। শশুড় বাড়ীর লোকজনের অত্যাচারে তিনি এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চন্দ্রঘোনা হিন্দুপাড়ায় মায়ের ঘরে চলে আসে। সেখানেও তার সুখ পাখি যেনো অধরা হয়ে রইল।
এরপর তিনি চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মনোজ বড়ুয়ার বাসায় কাজ নেয়। ডা.মনোজ বড়ুয়া ছাড়াও মিশন এলাকার অনেকের বাসাবাড়ীতে ঝি’য়ের কাজ করে কোন রকমে তার জীবন চলতো।
এরিই মধ্যে তার জীবনে আসে আরো একটি দুঃস্বপ্ন। ১৯৯২ সালে তার চোখে দেখা দেয় কঠিন রোগ। অপারেশন করতে গিয়ে তিনি হারান তার দু’চোখ। চোখ হারানোর পর অনেকের বাসায় তার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন মানুষের দেওয়া অন্ন বস্ত্রে তার জীবন চলে। যেদিন পাই সেদিন খাই,না পেলে কখনোও কখনোও পানি খেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েন লক্ষী রানী দে।
মিশন হাসপাতালের সামনের গেইটে ফল বিক্রেতা আব্দুল আউয়ালের সাথে আলাপকালে তিনি জানান,এই মহিলা দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে দিনের বেলা তার দোকানে বসে থাকেন, সন্ধ্যা হলে হাসপাতালের বারান্দায় চলে যান। অনেকে এসে কিছু সহায়তা করে থাকে।
চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রহরী মো.সিরাজ,জুনু চাকমা ও নাছের জানান,গত ১২ বছর ধরে হাসপাতালের বারান্দায় ওই মহিলা রাত্রী যাপন করছে। হাসপাতালের সামনে অন্ধ এই মহিলাকে তারা সবসময় চোখে চোখে রাখেন এবং খাবার দেন। হাসপাতালের পরিচালক ডা.প্রবীর খিয়াং জানান,১২ বছর ধরে তারা তাকে হাসপাতালের বারান্দায় বসবাস করতে দেখে আসছি। তারা একবার ওই মহিলাকে টাকা পয়সা দিয়ে তার এক আত্মীয়ের বাসায় দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তিনি আবার হাসপাতালের সামনে ফিরে আসে,তাই মানবিক কারনে তারা উনাকে থাকতে দিয়েছেন।
তিনি জানান,হাসপাতালের পক্ষ থেকে উনাকে প্রায়ই খাবার দেওয়া হয়। তবে ওই মহিলাকে যদি পূর্নবাসন করা যায়,সেক্ষেত্রে তারা সহায়তা করবেন। তিনি আরো জানান,তারা আবারও চেষ্টা করবেন তাকে তার আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে পূর্নবাসন করার জন্য।