ঢাকা ব্যুরো অফিস, ২৪ নভেম্বর ২০১৫, দৈনিক রাঙামাটি : আজ সকাল ১১টায় ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ তিনটি সংগঠন দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলী নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে। গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম সভাপতি- মাইকেল চাকমা, সাধারণ সম্পাদক- অংগ্য মারমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সভাপতি- সিমন চাকমা, সাধারণ সম্পাদক- বিপুল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন সভানেত্রী- নিরূপা চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি- থুই ক্য সিং সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন।
বক্তারা বলেন, ৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে গভীরভাবে সম্মান জানাই। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান-পরিবার পরিজনসহ নির্যাতিত নারী ও স্বজনহারা মানুষের মর্মবেদনা গভীরভাবে উপলদ্ধি করি, আমরা তাদের সমব্যথী এবং তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। বিপরীতে যারা এদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খার বিরোধিতা করেছিল, তাদের ধিক্কার ও ঘৃণা জানাই।
তারা বলেন, যখন দুই শীর্ষ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা কার্যকরের মধ্য দিয়ে ন্যায় বিচার পেয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান-পরিবার পরিজন দীর্ঘ চার দশক পর শ^স্তির নিঃশ^াস ফেলছে, খুনী অপরাধী গণশত্রুদের বিচার হচ্ছে দেখে নতুন প্রজন্ম সন্তোষ প্রকাশ করছে। এমনি সময়ে পাকিস্তান সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে মন্তব্য করে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। আমরা পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির নিন্দা জানাই।
তারা বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়তই মানবতা বিরোধী অনেক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটছে। যা সময় মত প্রকাশ পায় না, প্রায় ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থেকে যায়। সরকারের কাছে সে সব গুরুত্বহীন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত, এটা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আমরা মনে করি।
বক্তারা উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, সরকার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি দাবি করে দেশের শাসন ক্ষমতা নিজেদের একচেটিয়া কারবারে পরিণত করতে চাইছে। সরকার দিন দিন অসহিষ্ণু ও মারমুখী হয়ে উঠছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গণবিরোধী ১১দফা নির্দেশনা জারি থাকায় সেখানে পরিস্থিতি আরও খারাপ, যা আমরা যথাসময়ে উল্লেখ করবো।
আমরা জানি, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কেবল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যুদ্ধে অংশ নেয়নি। অংশ নিয়েছিল আরও অনেক দল, যারা অনেক সাহসী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছিল।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চাইতে বহু গুণ বেশী মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বিতরণের কাহিনী লোকের মুখে মুখে ফেরে। প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তারা আজ নানাভাবে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। পাহাড়ি জনগণ মুক্তিযুদ্ধের সময় ও স্বাধীনতার পরে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রয়াত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় পাইকারিভাবে পাহাড়িদের সবাইকে পাকিস্তানের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
ক্ষমতাসীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি, ধর্মনিরপেক্ষ, সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল ইত্যাদি দাবি করলেও বাস্তবে এর বিপরীত ধারাই লক্ষ্যণীয়। সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিভাবে আক্রান্ত ও তাদের জায়গা-জমি ক্ষমতাসীন দলের লোকজন দ্বারা বেদখল হচ্ছে, তা কমবেশী সবার জানা। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা তুলে ধরতে চাই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত খোদ নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়, যা নিয়ে তেমন কোন আলোচনা সমালোচনা নেই। গেল ১৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির বগাছড়িতে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের কর্মকর্তা ঐদিন পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দিয়ে “বিজয় উৎসবে” মেতে উঠেছিল। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার কথা আমরা জানি না।
নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে একশ্রেণীর কর্মকর্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংস হত্যাকা-সহ বিভিন্ন দুঃখজনক ঘটনার জন্য এরা দায়ী। তাদের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত অঘটন ঘটছে। বর্তমানে ঐ অঞ্চলে সেনা টহল ও ধরপাকড়ের কারণে জনজীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছে। খোদ খাগড়াছড়ি জেলা সদরেও একই অবস্থা। ক’দিন আগে বিনা ওয়ারেন্টে দোকান থেকে লোক ধরে নিয়ে নির্যাতন করে জেলে দেয়া হয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘœ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও “অপারেশন উত্তরণ” জারি রেখে সরকার সেনা খবরদারি বজায় রেখেছে। এ বছর ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে গণবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক “১১দফা নির্দেশনা” জারি করে সেনা শাসন বৈধতা দিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি অসহনীয় করে তুলেছে। জনগণের তীব্র প্রতিবাদ আপত্তি সত্ত্বেও সরকার এখনও সে নির্দেশনা প্রত্যাহার করেনি। আমরা উদ্বেগের সাথে দেখতে পাচ্ছি, গণবিরোধী ঐ নির্দেশনা জারির পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে দমন-পীড়ন আগের চেয়ে তীব্রতর হয়েছে। সেনা-বিজিবি-পুলিশ স্থাপনা নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও সংস্কার জোরদার হয়েছে। অন্যায়ভাবে ধরপাকড় বেড়েছে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বিনা উস্কানিতে হামলা, মারধর করে নিরীহ লোকজনকে ধরে জেলে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ভূমি বেদখলও আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। সেটলারের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
প্রিয় বন্ধুরা,
আপনারা হয়ত এও অবগত আছেন যে, বৈসাবি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তম সামাজিক উৎসব। এ উপলক্ষে এ বছর ১২ এপ্রিল স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে খাগড়াছড়িতে র্যালি আয়োজন করা হলে নিরাপত্তা বাহিনী তাতে হামলা চালিয়ে ভ-ুল করে দেয়। র্যালির ব্যানার কেড়ে নিয়ে লাঠিপেটা করে এবং দুই পিসিপি কর্মীকে ধরে নিয়ে দীর্ঘ দিন আটক রাখে।
আমরা দেখেছি, বৈসাবি ছুটির ঐচ্ছিক ছুটি বাড়ানো হয়েছে বলে সরকার প্রচার মাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচার চালিয়েছিল। বাস্তবে ঐচ্ছিক ছুটি আগেও ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের দাবি হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বিশেষত্ব ও জাতিসত্তাসমূহের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে স্বীকৃতিদান স্বরূপ বৈসাবি’র তিন দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা দেয়া, এ বছরের ছুটির তালিকায় তা নেই। ঐচ্ছিক ছুটি দেখিয়ে বলতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।
বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস করিয়ে আমাদের জাতিসত্তার পরিচিতি কেড়ে নেয়া হয়েছে, অন্যায় জবরদস্তিমূলকভাবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে “বাঙালি” জাতীয়তা। প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার এখনও তা বাতিল করে নি। ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১১ দফা নির্দেশনা জারি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত কায়েম করা হয়েছে সেনা শাসন।
আমরা দেশের গণতান্ত্রিক ধারার সাথে সম্পৃক্ত। আমরা শুধু নিজেদের দাবি-দাওয়ার জন্যই আন্দোলন করছি তা নয়, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে যে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা রয়েছে, তাদের দাবির প্রতিও সমর্থন দেই। দেশের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের ভাত-কাপড়ের ন্যায্য দাবির সাথেও আমরা একাত্ম এবং দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের আন্দোলনেও আমরা যুক্ত রয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্ধ দাবি করেন, জেলা পরিষদ কর্তৃক দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। রাঙ্গামাটিতে মেডিক্যাল কলেজ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুযোগ সুবিধার বন্দোবস্ত করতে হবে। আটককৃত নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের জারিকৃত গণবিরোধী ১১দফা নির্দেশনা বাতিল করতে হবে। বগাছড়িতে ১৬ ডিসেম্বর হামলাকারী সেনা কর্মকর্তা ও জোয়ানদের বিচার ও শাস্তি প্রদান করতে হবে। গুইমারা রিজিয়নের সাম্প্রদায়িক সেনা কর্মকর্তাসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে অন্যত্র বদলী করতে হবে।
ছবি- শামীমুল আহসান