॥ আলমগীর মানিক ॥
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে অবৈধভাবে গড়ে উঠা ইটের ভাটাগুলো আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংস করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি ফাতেমা নজীবের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৪ই মার্চ সোমবার এ আদেশ দেন। তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকগণের দাখিল করা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, তিন জেলায় ১৩০টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।
এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এতে বলা হয়, ৩ পার্বত্য জেলার ২০টি উপজেলায় থাকা ৬৪টি অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। সেদিন আদালত ৯ই মার্চের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপক্ষ তিন জেলা প্রশাসকের তালিকা আদালতে দাখিল করে।
সোমবার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরে মনজিল মোরসেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ইটভাটা নিয়ন্ত্রন আইনের ১৪ ও ১৯ ধারা অনুসারে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি অবৈধ ইটভাটাগুলো ধ্বংস করে ছয় সপ্তাহের মধ্যে তিন জেলার জেলা প্রশাসককে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়েছে।
এর আগে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) ওই রিট করে। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। ওই জেলাগুলোতে থাকা সব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাত’দিনের মধ্যে বন্ধের ব্যবস্থা নিতে তিন জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
এ ছাড়া সেখানকার লাইসেন্সবিহীন সব ইটভাটার তালিকা ছয় সপ্তাহের মধ্যে আদালতে দাখিল করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আদালতে ওঠে।
সবুজ পাহাড় এবং কৃষিজমিতে জ্বলছে ইটভাটার চিমনি। ভাটার ধোঁয়ায় বিপর্যস্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। ভাটা নির্মাণের জন্য পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে। এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি এসব ভাটার সবকটি অবৈধ।
অনুসন্ধানের দেখা গেছে, রাঙামাটির প্রায় ইটভাটাগুলোতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন পুরোপরি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এসব লাইন্সেসবিহীন ভাটা থেকে সরকার কোনো রাজস্বও পাচ্ছে না। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। এতে ভাটার আশপাশের এলাকা, নদী, শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ জনপদের জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটা সৃষ্ট দূষণে বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডাজনিত নানা রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইটভাটাগুলোতে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে জ্বালানি কাঠ। এতে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। অধিকাংশ ইটভাটায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ইট পোড়ানো কার্যক্রম। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইনে (২০১৩) নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ ভাটাই স্থাপন করা হয়েছে বা হচ্ছে লোকালয় তথা মানুষের বসতবাড়ি, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরের অতি সন্নিকটে, কৃষি জমিতে, নদীর তীরে, পাহাড়ের পাদদেশে। ইটভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে আবাদি জমির উপরিভাগ, নদীর তীর এবং পাহাড়ের মাটি, যা আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাঠ ও অত্যন্ত নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো এবং স্বল্প উচ্চতার ড্রাম চিমনি ব্যবহার করায় ইটভাটাগুলোতে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়া। সে ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে চার পাশে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।