নিরবে পার হয়ে গেলো পাকুয়াখালী দিবস কাঠুরিয়া পরিবারগুলোতে হতাশার অন্ধকার

329

॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥
হত্যাকান্ডের দুই যুগের বছর মঙ্গলবার নিরবে নিভৃতে পার হয়ে গেলো পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস। তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করেনি কেউ। শুধু ৩৫ কাঠুরিয়ার স্বজনরা অশ্রুসজল নয়নে লংগদুতে গণকবরের পাশে দাঁড়িয়েছিল আশাহত মন নিয়ে। এখন তারা বুঝে গেছে এই হত্যাকান্ডের বিচার হয়তো আর কখনই হবে না। আগে বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি এলে নানা কর্মসূচি নিয়ে সোচ্চার হতো, এবার তাও হয়নি। কাঠুরিয়া পরিবারগুলোর চোখে এখন শুধুই হতাশার অন্ধকার। কেউ দিবসটি ঘিরে কোনো কর্মসূচি পালন করে থাকলেও কাউকে জানানো হয়নি।

৯ সেপ্টেম্বর পাকুয়াাখালী ট্রাজেডি তথা ৩৫ কাঠুরিয়া হত্যাকান্ড দিবস। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের শোকাবহ এক কালোদিন। ১৯৯৬ সালের এই দিনে রাঙামাটির লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী পাকুয়াখালী নামক গহীন অরণ্যে তৎকালীন বিচ্ছিন্নতাবাদি উপজাতীয় সন্ত্রাসী গ্র“প শান্তি বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় ৩৫ নিরীহ বাঙালি কাঠুরিয়া। সেসময় পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া চলছিলো।

সেই থেকে পার্বত্য এলাকায় বাঙালিরা এ দিনটিকে পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস হিসেবে পালন করে আসছিল, এবার তার ছন্দপতন হলো। দিবসটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু গণহত্যার মধ্যে অন্যতম ঘটনা। দুই যুগেও এই হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। সেদিনের এতিম এখন তরতাজা যুবক, কিন্তু পিতৃ হত্যার বিচার না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত নিহতদের পরিবার।

প্রতি বছর হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে দিবসটি পালন করতো পার্বত্য বাঙালিরা। দিনটিতে লংগদু উপজেলায় শহীদদের কবর জিয়ারত, শোক র‌্যালি, দোয়া ও আলোচনা সভা করা হতো।

১৯৯৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শান্তি বাহিনী লংগদুর ৩৬ জন কাঠুরিয়াকে ব্যবসায়িক লেনদেনের (চাঁদা নির্ধারন) কথা বলে পাকুয়াখালী নামক গহীন অরণ্যে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে কাঠুরিয়াদের তিন দিন আটকে রেখে হাত-পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয়। আটক ৩৬ জন কাঠুরিয়ার মধ্যে ইউনুচ নামের একজন কাঠুরিয়া পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে খবর দিলে ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ ও সেনাবাহিনী পাকুয়াখালীর জঙ্গল হতে ২৮ জন কাঠুরিয়ার ক্ষত বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। বাকি সাত কাঠুরিয়ার লাশ পাওয়া যায়নি।

বর্বর এ হত্যাকান্ডের স্মরণে এখনো কেঁদে উঠে লংগদুর মানুষ। খুনীদের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরত আসা ইউনুছ ঘটনার বর্ণনায় বলেন, সেনাবহিনী যখন জানলো যে আমাকেও শান্তি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তখন তারা লাশের সন্ধান করার জন্য আমাকেও সাথে নেয় পথ দেখানোর জন্য। আমি তাদের পাহাড়ে নিয়ে গেলাম।

ঘটনার সময় তক্তা নজরুলকে যেখানে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো শান্তিবাহিনীরা, সেখান থেকে আরেকটু সামনে গিয়ে দেখলাম বাম দিকে একটি বাঁশের বেড়া। নীচে নেমে সেই বেড়া পার হলাম। তার পর আর রাস্তার চিহ্ন নেই। একটু দুরে দেখলাম একটা কাঁচা বাঁশের কঞ্চি আধ ভাঙ্গা অবস্থায় ঝুলে আছে। কঞ্চিটা সরানোর পর একটা পথ পেলাম। পথ বেয়ে সামনে গিয়ে দেখি সরাফুদ্দি ভাইয়ের টুপিটা একটা কঞ্চির সাথে লেগে আছে। এর পর স্যান্ডেল, মদের টেংকি, বেশ কয়েকটা লাঠি দেখলাম, তারপর দেখলাম আলাল ভাইয়ের লাশ। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখি বিশাল জায়গা জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। কাউকে চেনার উপায় নাই। বন্দুকের ব্যানেট, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে খুঁচিয়ে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, চোখ তুলে, দা দিয়ে কুপিয়ে একেকজনকে হত্যা করা হয়েছে। ঐ কথা মনে হলে আজো শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায়। ইউনুছের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় এ হত্যাকান্ড কতটা পৈচাশিক ছিল।

এ ঘটনার পর পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি সংসদীয় টিম লংগদু সফর করে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়। এর পরবর্তী সরকারগুলোও একই আশ্বাস দিয়ে আসলেও এখনো এ ঘটনার মামলার কোনো কুল কিনারা হয়নি এবং পুনর্বাসিত হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। বিচার না পেয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত কাঠুরিয়া পরিবারগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে।