-মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ ওসমান গণী চৌধুরী
হে হাবিব, আমি তো আপনাকে জগত সমূহের জন্য রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি। -সূরা আম্বিয়া(আয়াত- ১০৭),
হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর শুভ আগমনের দিন কেবল মুসলমানদের নয়, সকল সৃষ্টিজগতের জন্য আনন্দ বা খুশির দিন, গোটা পৃথিবী যখন অজ্ঞতা, নির্মমতা, বর্বরতা, অত্যাচার, নির্যাতন, পাপাচার, পাশবিকতায় ডুবন্ত ছিল ঠিক সেই মুহুর্তে আল্লাহ্র প্রিয় হাবিব, সৃষ্টিজগতের রহমত মানব জাতির কল্যাণকামী এবং দাসত্বের জিনজির থেকে মুক্তিদাতা আল্লাহ্র প্রিয় হাবিব হুজুর সারোয়ারে কায়েনাত, আকায়ে নামেদার, শফিউল মোজনেবীন হযরত মুহাম্মদ(দঃ) ১২ ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার দুনিয়াতে তশরীফ আনেন।
আল্লাহ্র প্রিয় হাবিবের আগমন সারাবিশ্বের জন্য রহমত দয়া হিসাবে, তাই আসমান খুশী উদযাপন করছে, জমিন খুশী উদযাপন করছে, ফেরেস্তাগন খুশী উদযাপন করছে, তাই সারাবিশে^র মুসলমানগণ অত্যন্ত খুশী ও মোহব্বতের সাথে, রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে-ই-মিলাদুন্নবী(দঃ) পালন করে থাকেন। এখানে বুঝা গেলো আল্লাহ্ যার জন্য রব নবী করিম হযরত মুহাম্মদ(দঃ) তার জন্য রহমত। সুতরাং হুজুরের রহমত শর্তহীন, পরিপূর্ণ ও পুনাঙ্গ, সর্বব্যাপী, ব্যাপক, দৃশ্য ও অদৃশ্য জগত ব্যাপী এবং ইহ ও পরকাল উভয় জাহানের স্থায়ীভাবে রহমত (তাফছিরে নূর ইরফান)।
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
আপনি বলুন আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন সম্পদ অপেক্ষা শ্রেয়-(সূরা ইউনুস আয়াত-৫৮), তাফসীরকারকগণ বলেছেন আল্লাহ্র অনুগ্রহ হলেন হুজুর হযরত মুহাম্মদ (দঃ)। মহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন,
হে হাবীব আপনার উপর আল্লাহ্র মহা অনুগ্রহ রয়েছে (সূরা নিসা আয়াত-১১৪)।
পৃথিবীর বুকে হুজুর হযরত মুহাম্মদ(সঃ) এর শুভ আগমনকে মানবজগতের জন্য বড় ইহসান (দয়া)
হিসাবে উল্লেখ করে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন,
নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মুমিনদের উপর বড় ইহসান(দয়া) করেছেন যে, তাদের মাঝে নিজেদের মধ্যে হবে (মানব বংশ) তাদের কাছে একজন সম্মানিত রাসুল প্রেরণ করেছেন। যাতে তিনি তাদের নিকট আল্লাহ্র আয়াত সমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে যাবতীয় পাপ ও গুনাহ্ এবং নাপাকি থেকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কুরআন-হাদিসের শিক্ষা দান করেন, যদিও তারা তাঁর শুভাগমনের পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।(সূরা আল ইমরান (আয়াত-১৬৪)।
এ আয়াত থেকে বুঝা গেলো যে, হুজুর হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর শুভাগমন সর্বপেক্ষা বড় নিয়ামত কারণঃ
শব্দটা কুরআন শরীফে অন্য কোন নেয়ামতের বেলায় ব্যবহার হয়নি। কারণ সব নেয়ামত ধ্বংসশীল ঈমান হচ্ছে একমাত্র চিরস্থায়ী সুতারাং হুজুর হযরত মুহাম্মদ (দঃ) হলেন ব্যাপক ও পূর্নাঙ্গ নিয়ামত (নুরুল ইরফান) সাধারণত পার্থিব নিয়ামত বা অনুগ্রহ লাভ করার কারণে যদি খুশী উদযাপন করা যেতে পারে, তবে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ, বড় দয়া অর্থাৎ মহান রাসূলের আগমনের মুহুর্তে, মাস, দিন ক্ষণকে স্মরণ করে খুশী আনন্দোৎসব করা যে, উত্তম কাজ, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই।
মহান রাব্বুল আলামীন আরো ইরশাদ করেছেন-
নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে তাশরীফ এনেছেন তোমাদের বংশ হতে এমন সম্মানিত রাসূল যাঁর কাছে তোমাদের কষ্টে পড়াব ড়ই কষ্ট দায়ক। তিঁনি তোমাদের কল্যাণ অতি মাত্রায় কামনাকারী, মুমিনদের জন্য পূর্ণ দয়ার্দ্র, আর বড়ই দয়ালু-সূরা (ওবা আয়াত-১২৮)। এ আয়াতে পাকেও আল্লাহ্ পাক সমস্ত বিশ্ববাসীকে সম্বোধন করে, রাসূলে পাক হযরত মুহাম্মদ(দঃ) এ পৃথিবীতে আগমন করাকে তাঁর অনেক গুনাবলীও মর্যাদা সহকারে বর্ণনা করেছেন।
হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা রাসূল হযরত মুহাম্মদ(দঃ)-কে আপন দুটি নাম “রউফ” প্রিয় দয়ার্দ্র ও রহীম (অসিম দয়ালু) দ্বারা নাম করণ করে নেহায়ত সম্মানিত করেছেন।(তফসিরে কবির ৮ম খন্ড-২৩৬-২৩৭)।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আরো ইরশাদ করেছেন-
হে বিশ্ববাসী নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের পালন কর্তার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে এবং আমি তোমাদের প্রতি উজ্জল আলো অবর্তীন করেছি,(সূরা নিসা আয়াত-১৭৪)।
এখানে বোরহান মানে হুজুর মুহাম্মদ (দঃ) বিশ্ব বিখ্যাত তফসির বিশারদ ঈমান ফখরুদ্দীন রাজী(রাঃ)বলেনঃ অর্থাৎ উক্ত আয়াতে প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ(দঃ)-কে ‘বোরহান বলা হয়েছে। যেহেতু তাঁর দায়িত্ব হক এবং ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাতিল ও অন্যায়কে খন্ডন করার জন্য অকাট্য প্রমাণ পেশ করা (তাফসিরে কবির সূরা নিসা-পৃষ্ঠা-৯৩)
হাদিস শরীফের আলোকে মিলাদুন্নবী উদযাপনঃ রাসূল পাক হযরত মুহাম্মদ(দঃ)-এর মিলাদ শরীফকে
সম্মানের কারণে কাফেরের আযাব রহিত হয়ে যায়। সহীহ্ বুখারী শরীফে আছে।
অর্থাৎ আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার পরিবারের কাউকে হযরত আব্বাস(রাঃ) স্বপ্ন দেখানো হল যে, সে খারাপ অবস্থায় আছে। স্বপ্নদ্রষ্টা তাকে বলল, তোমার কী অবস্থা ? আবু লাহাব বলল, আমি অত্যন্ত আযাবের মধ্যে রয়েছি; তবে রাসূল হযরত মুহাম্মদ(দঃ) জম্মের উপর খুশী হয়ে ছুয়াইবাকে মুক্তি দেওয়ার কারণে সেদিন তথা সোমবার আমাকে পান করানো হয়।
ইমাম ইবনে হাজর আসকালনী আলাইহির রহমত ইমাম সুহাইলী আলাহির রহমত থেকে বর্ণনা করেনঃ
হযরত আব্বাস(রাঃ)বলেনঃ আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি যে, সে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। অতঃপর সে বলল, তোমাদের ছেড়ে আসার পর আমি কোন শান্তি পাইনি তবে প্রতি সোমবার আমার শাস্তি কিছুটা কমানো হয়। ইমাম সুহাইলী বলেন ঃ কারণ নবী করিম হযরত মুহাম্মদ(দঃ) সোমবার জন্ম গ্রহণ করেছেন। আর আবু লাহাবের দাসী ছুয়াইবা নবী করিম হযরত মুহাম্মদ(দঃ) জন্ম গ্রহণের সুসংবাদ আবু লাহাবকে দিলে সে আনন্দিত হয়ে তাকে(ছুয়াইবা) দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়।
এই হাদিসের ব্যাখায় হাফেজ ইবনুলূর জামরী(আঃ) বলেনঃ
কাফের আবু লাহাব যার নিন্দায় কুরআন পাকের একটি সূরা(সূরা লাহাব) অবর্তীন হয়েছে, সে যদি ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের কারণে কম শাস্তি ভোগ করে, তাহলে উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে মুসলিম ব্যক্তির কী প্রতিদিন হতে পারে যে ঈদে-ই-মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন এবং এ উপলক্ষে নবী করিম হযরত মুহাম্মদ(দঃ)-এর প্রেমে তাঁর সামর্থ অনুযায়ী খরচ করেন। আমার জীবনের কসম করে বলছি, দয়াময় আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাঁর প্রতিদান হল, আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুন নয়ীমে প্রবেশ করাবেন।
উপরোক্ত পর্যালোচনা দ্বারা প্রমাণিত হল যে, পবিত্র ঈদে-ই-মিলাদুন্নবী(দঃ) উদযাপন করা শুধুমাত্র বৈধ নয়; বরং মহান আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবিব নবী করিম হযরত মুহাম্মদ(দঃ) সন্তুষ্টির এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক কল্যাণ হাছিলের অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম।
অতএব ঈদে-ই-মিলাদুন্নবী(দঃ) উদযাপন করা কুরআন, সুন্নাহ সম্মত হওয়া সত্ত্বেও একে অস্বিকার করা পথভষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। সুতারাং মুমিনদের উচিত কোন প্রকার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে বিশুদ্ধ নিয়্যত ও নিয়মে পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী(দঃ) উদযাপন করা।
[লেখকঃ সভাপতি, জাতীয় ইমাম সমিতি, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা। মোবাইল নম্বরঃ ০১৮২৮-৮৯৫৪৬৮]