পার্বত্য ভূমি সমস্যার সমাধানে গঠিত পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কার্যক্রম শুরু করার পথে বড় বাধা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ নীতিমালার চূড়ান্তকৃত খসড়া অতিদ্রুত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের মাধ্যমে আসন্ন সংসদ অধিবেশনে উপস্থাপনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে পত্র প্রেরণের সুপারিশ করা এবং ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল রেগুলেশন-২০১৮ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা-২০১৬ প্রণয়নের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করার পরেও সংসদে উত্থাপন করে গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি।
মঙ্গলবার কমিটির ৩২তম বৈঠকে অবিলম্বে জাতীয় সংসদের চলমান অধিবেশনেই এই বিষয়টি উত্থাপন করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতি জোর সুপারিশ জানিয়েছে সংসদীয় কমিটি। বৈঠকে উপস্থিত ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের মাধ্যমে এই সুপারিশমালা প্রেরণ করা হয়। উক্ত বৈঠকে উপস্থিত দায়িত্বশীল সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বৈঠক সূত্রে জানাগেছে, ২০১৬ সালের আগষ্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এর ফলে পার্বত্য এলাকায় দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক ধরে ভূমি নিয়ে চলমান বিরোধ নিষ্পত্তি হবে বলে সরকার মনে করছে।
সে সময় পহেলা আগষ্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় বিষয়টির নানাদিক পর্যালোচনাপূর্বক চুড়ান্ত আকারে প্রকাশে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৩১তম বৈঠকে ভূমি মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়।
কিন্তু মন্ত্রণালয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এই বিষয়টি বেশি দূর এগুয়নি। যার ফলশ্রুতিতে জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে বিষয়টি এখনো পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়নি। এই বিষয়টি নাহলে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় এগুতে পারছেনা।
৩ জুলাই মঙ্গলবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তাই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিটির সভাপতি র আ ম ওবাদুল মোক্তাদির এমপি ও পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর ঊশৈসিং এমপি।
এসময় জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনেই ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল রেগুলেশন-২০১৮ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা-২০১৬, নীতিমালা উপস্থাপন করে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতি জোর সুপারিশ জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের কেবিনেট কক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৩২তম সভায় সভাপতিত্ব করেন র-আ-ম ওবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী-এমপি। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর-এমপি, শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা-এমপি, ২৯৯ আসনের ঊষাতন তালুকদার-এমপি, এম এ আউয়াল-এমপি, পার্বত্য মন্ত্রণালয় সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আব্দুল্লাহ, প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানগণ, পুলিশের ডিআইজি মোঃ রুহুল আমিনসহ ভুমি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় সমূহের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এসময় উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, পাহাড়ে সম্প্রীতি ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডগুলোসহ সশস্ত্র কার্যক্রম নিয়েও এই বৈঠকে আলোচনা হয়। পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতার ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিকদলীয় কোন্দলে হত্যাকান্ডের পুনরাবৃত্তিরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে বিগত ৩১তম বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুপারিশ করার পরেও অত্রাঞ্চলে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু না হওয়ায় বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর-এমপি।
এসময় তিনি পাহাড়ে নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যে সকল সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সে-সকল খালি ক্যাম্পের স্থানগুলোতে পুলিশের ক্যাম্প স্থাপন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের দাবি জানান।
জবাবে পুলিশের পক্ষ থেকে হেডকোয়ার্টার থেকে অংশ নেওয়া ডিআইজি পদমর্যাদার জনাব রুহুল আমিন পাহাড়ে পুলিশের অবস্থান তুলে ধরে জানান, জিওগ্রাফিক্যাল কারনে পার্বত্যাঞ্চল একটি দূর্গম এলাকা হওয়ায় অত্রাঞ্চলে অস্ত্র উদ্ধারের মতো অভিযান পরিচালনা করা পুলিশের জন্য একটু জটিল।
কিন্তু তারপরও অত্রাঞ্চলে পুলিশের টহল বাড়ানোর পাশাপাশি পাহাড়ে সেনাবাহিনীর সাথে চলমান অপরাধ দমনে যৌথ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এসময় বৈঠকের সভাপতি সংসদ সদস্য র-আ-ম ওবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অত্রাঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মোটিবেশনাল কর্মকান্ড বৃদ্ধি করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে পাহাড়ে কর্মরত বিদেশী উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি কর্তৃক পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ এনজিও কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ত করার জন্যে বিগত বৈঠকের ন্যায় মঙ্গলবার ইউএনডিপি’র প্রতিনিধিকে তাগাদা প্রদান করা হয়।
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থা, অত্রাঞ্চলে বসবাসরত নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির ভাষা-সংস্কৃতিক-রীতিনীতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রদানের লক্ষ্যে পদায়নকৃত সংশ্লিষ্ট্য কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি ওরিয়েন্টেশন কোর্স পরিচালনার সুপারিশ করা হয় আজকের সভা থেকে।
এদিকে, সভায় অন্যান্য বিষয়ের সাথে কর্ণফুলী পেপার মিলস এর সার্বিক বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। উক্ত আলোচনায় সভাপতি মহোদয়ের বক্তব্যের পর শিল্প সচিব মোঃ আব্দুল্লাহ, সংসদ ঊষাতন তালুকদার, প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর সহ অন্যান্যরা কেপিএমকে পূর্ণাঙ্গভাবে সচল এবং শ্রমিক কর্মচারীসহ অন্যান্য সকলের যাবতীয় বকেয়া দ্রুত পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
এসময় বিসিআইসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাইয়্যুল কাইয়্যুম, পরিচালক (উৎপাদন) শাহিন কামাল, উর্ধ্বতন মহা ব্যবস্থাপক আসাদুর রহমান টিপু, কেপিএম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এম এ কাদের উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় কেপিএমকে পূর্ণাঙ্গভাবে সচল করতে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং অনতিবিলম্বে সংসদীয় কমিটি থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম কেপিএম পরিদর্শনে যাবে।
বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের একান্ত সহকারী এম.আর. হোসাইন জহির প্রতিবেদককে জানান, কেপিএম তিন পার্বত্য জেলার অর্থনীতির সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত। কেপিএমকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলায় ব্যাপক বনায়ন ও অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্য প্রসার হয়েছে।
বর্তমানে কেপিএম এর অচলাবস্থার কারনে তিন পার্বত্য জেলার অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং কেপিএম নির্ভর লক্ষ লক্ষ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। মাননীয় সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকার অন্যান্য উন্নয়নের পাশাপাশি দীর্ঘদিন যাবৎ কেপিএম এর সমস্যা সমাধানের লক্ষে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তারই ধারাবাহিকতায় সংসদের সর্বোচ্চ ফোরামে কেপিএম এর বিষয়টি তিনি উত্থাপন করেছেন। মঙ্গলবার এই আলোচনায় শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বিসিআইসির সকল নীতি নির্ধারক উপস্থিত থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কেপিএম কে আবারো সচল করার যে উদ্যোগ নিয়েছে -আমি মনে করি তিন পার্বত্য জেলার অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত খুশির খবর।