পাহাড়ে সকল জাতি গোষ্টির মানবাধিকার সুরক্ষায় জীবন্ত কিংবদন্তী মকছুদ আহমেদ

332

॥ অরূপ মুৎসুদ্দী  ॥
প্রথমে বলে রাখা ভালো আমি কোনো লেখক নই, তাই লিখতে গিয়ে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাই প্রিয় পাঠক মহল ভুল গুলো শুদ্ধ করে পড়ে নেবেন সেটা প্রত্যাশা রইলো। পাবর্ত্যাঞ্চলের সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিক জগতের কথা বলতে গেলেই সবাই কম বেশী এক বাক্যেই স্বীকার করবেন পার্বত্যাঞ্চলের সর্ব প্রথম প্রকাশিত “দৈনিক গিরিদর্পন” এর প্রকাশক ও সম্পাদক প্রবীন সাংবাদিক জনাব আলহাজ্ব একে এম মকছুদ আহমেদ পার্বত্যাঞ্চলের চারন সাংবাদিক হিসাবে খ্যাত,শুধু তাই নয় তিনি সাংবাদিকতা জগতের একজন পথ প্রদর্শক আর সাংবাদিকতার মুর্ত প্রতিক।

আজ রাঙামাটিসহ পার্বত্যাঞ্চলে যারাই সাংবাদিকতা করেছেন বা করছেন এর মধ্যে অনেকেই এর হাত ধরেই  এই পেশাতে এসেছেন। এর মধ্যে আমারো জনাব আলহাজ্ব একে এম মকছুদ আহমেদ’র সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিলো। এর সুবাদে আমারও “দৈনিক গিরিদর্পন” পত্রিকা দিয়ে লিখালিখি বলুন বা সাংবাদিকতা বলুন এর  শুরু।  আজযে কিছু লিখছি এটা তাঁরই হাতে কড়ি। তবে “দৈনিক গিরিদর্পন” যেখানে পেয়েছিলাম আমার লিখন গুরু শ্রদ্ধেয় এবং স্বর্গীয় সাংবাদিক শৈলেন দে দাদাকে। আর জনাব একে এম মকছুদ আহমেদ আমার লিখা-লিখির আশ্রয় দাতা।

যার জন্য আমি উনাকে বস্ বলে সম্বোধন করতাম এবং এখনও করি। আমার স্বর্গীয় পিতা চিত্ত রঞ্জন মুৎসুদ্দী সবাই যাকে চিত্ত মাষ্টার হিসাবে চিনতো বা জানতো,তাঁর মুখে শুনেছি বস্ নাকি প্রথমে একজন শিক্ষক ছিলেন এবং বাবার সহকর্মী ছিলেন। সে সুবাদে আমাদের পরিবারে সাথে একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো।

শিক্ষকতা পেশা  থেকেই তিনি  চট্টগ্রাম’র বহুল প্রচারিত “দৈনিক আজাদী” পত্রিকায় লিখা-লিখির মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা শুরু। সেই থেকে বর্তমান পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে এখানকার মানুষের কারো অজানা নয়।তাই  পার্বত্যাঞ্চলের সবাই জনাব আলহাজ্ব একে এম মকছুদ আহমেদকে সাংবাদিকতা জগতের পথ প্রদর্শক এবং সাংবাদিকতার মুর্ত প্রতিক হিসাবেই জানেন। আমি আজ উনার আরও একটি গুনের কথা উপস্থাপন করতে চাই। যেই গুনের কথা না বললে বস্ কে যথাযথ মুল্যায়ন করা হবেনা। উনার যে যোগ্যতা, দক্ষতা এবং গুনাবলী তার পরিপূর্ণতা আসবেনা। তাই এই কথা গুলো একান্তই বলা এবং তা প্রকাশ করা প্রয়োজন।

আলহাজ্ব একে এম মকছুদ আহমেদ একাধারে সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং  প্রকাশক এর পাশাপাশি তিনি কিন্তু একজন নির্ভিক মানবাধিকার কর্মী। পার্বত্যাঞ্চলে বনবাসরত বাঙ্গালী জাতি গোষ্ঠী এবং চাকমা,মার্মা,গুর্খা,মগ,খেয়াংসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর ১৩ টি সম্প্রদায় স্ব-স্ব অবস্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস ও তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জনাব একে এম মকছুদ আহমেদ’র ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। তিনি যদিও একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিম সম্প্রদায় তথা বাঙ্গালী কিন্তু হিন্দু মুসলিম,বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বী, সকল সম্প্রদায়ের মানবাধিকার সুরক্ষা এবং সংরক্ষণে ছিলো সর্বদা সচেষ্ট ও সোচ্ছার।

তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হিসাবে পার্বত্যাঞ্চলে বিশেষ করে রাঙামাটিতে যেসব মানবাধিকার সংগঠন ছিলো বা এখনো আছে সেসব মানবাধিকার সংগঠন বা সংস্থা গুলোতে সরাসরি জড়িত ছিলো। সে  বাংলাদেশ  মানবাধিকার কমিশন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার; বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা এবং পরিবেশ ও মানবাধিকার উন্নয়ন সোসাইটি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা কার্যকরী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে ছিলেন। এসব সংগঠনের দায়িত্ব পালনকালে জনাব একে এম মকছুদ আহমেদ পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী, উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গুলোর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং তাদের অধিকার সুরক্ষায় নিরলস ভাবে কাজ করে গেছে। পাহাড়ে ভাতৃঘাতি,সংঘাত,অস্ত্রের ঝনঝনানি  বন্ধে তিনি ছিলেন অবিচল।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পেছনেও ছিলো মকছুদ আহমেদ’র অসামান্য অবদান। কেননা পাহাড়ের অধিকার বঞ্চিত মানুষ গুলোর কথা সে বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় তাঁর কলমের মাধ্যমে তুলে ধরতেন। ঘুরে বেড়াতেন পার্বত্যাঞ্চলের প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকা গুলোতে। তুলে আনতেন সেখানকার বাস্তব চিত্র গুলো। তিনি তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, পার্বত্যাঞ্চলের দীর্ঘ দুই যুগের পুঞ্জিভূত সমস্যা অস্ত্র দিয়ে সমাধান করা যাবেনা। এর সমাধান হতে হবে ডায়লগ’র মাধ্যমে। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই পার্বত্য শান্তি চুক্তি।

জনাব আলহাজ্ব একে এম  মকছুদ আহমেদ সত্যিকার অর্থে একজন নির্ভিক মানবাধিকার কর্মী। তাঁর আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বছরটি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ আজ থেকে ২১ (একুশ) বছর আগের কথা। ২৮ আগষ্ট ১৯৯৯ খ্রিঃ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলার জেলার বিভিন্ন উপজেলার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সমুহে ৮৫ (পঁচাশি) জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ পেয়ে ৮৫ জন সহকারী  শিক্ষক তারা স্ব-স্ব বিদ্যালয়ে যথা সময়ে বিধি

মোতাবেক যোগদান করতঃ তাদের কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় মাস দুই এক’র মধ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক ৮৫ জন শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমা নিয়োগ আদেশ অবৈধ আখ্যায়িত করে জেলা রাঙ্গামাটি পার্বত্য পরিষদ কর্তৃক নিয়োগকৃত ৮৫ (পঁচাশি)জন শিক্ষকের নিয়োগ আদেশ বাতিল করলেন।

এরপর ৮৫ জন শিক্ষক ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিবাদ জানান এবং আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য আমাকে আহ্বায়ক করে একটি “নবনিযুক্ত শিক্ষক অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি” নামে ৭ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এরপর আস্তে আস্তে শিক্ষকদের নিয়োগ আদেশ বহাল রাখার দাবীতে আন্দোলন গড়ে তুলি। সেই আন্দোলনে আঞ্চলিক পরিষদ,রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ,জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ঘেরাও, জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি পেশসহ একটার পর একটা কর্মসুচী ঘোষনা করা এবং তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছিলো।শেষ পর্যন্ত সড়ক অবরোধ হরতালের মতো কর্মসূচী পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিলো।

এই সমস্ত ছোট বড় কর্মসূচী গুলো বাস্তবায়নে সমন্বিত সরকারী কর্মচারী কল্যাণ সমিতি  রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা আমাদের সর্বাত্মক সহযোগীতা করেছিলো।এছাড়া তৎকালীন সময়ের সাংবাদিক ভাইয়েরা অধিকার বঞ্চিত শিক্ষকদের কর্মসূচী এবং দাবী গুলো তাদের লিখনী এবং প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করেছিলো।

রাঙামাটিতে আইনি পরামর্শের জন্য সার্বক্ষনিক সহযোগীতা দিয়েছিলেন রাঙামাটি জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি শ্রদ্ধেয় জনাব এডভোকেট মোখতার আহম্মদ। এই আন্দোলন চলে টানা দুই বছর। কোনও কিছুতেই কর্তৃপক্ষের বা সরকারের টনক নড়েনি। দেখতে দেখতে ২০০১ খ্রিঃ, তারিখটি ঠিক মনে পড়ছে না, রাঙ্গামাটিতে ৯ জন বিদেশী অপহরন হলো। মিডিয়াতে ঝড় উঠলো।

দেশ জুড়ে তখন একটিই আলোচনা ৯ জন বিদেশী অপহরণ। সেই সময় কোন একদিন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট চিকমা হুদা ম্যাডাম,এডভোকেট এলিনা খান ম্যাডাম সহ ৫ জনের একটি টিম ৯ বিদেশী অপহরণ ঘটনা তদন্তে রাঙ্গামাটি  পরিদর্শন করেন। সেই সময় বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা,রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সভাপতি ছিলেন প্রথিতযশা, চারণ সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় জনাব আলহাজ্ব একে এম মকছুদ আহমেদ। সেই সুবাদে এডভোকেট চিকমা হুদা ম্যাডাম সহ তদন্ত টিম উনার সাথেও স্বাক্ষাতে মিলিত হয়।

আর তখনিই জনাব মকছুদ আহমেদ আলোচনা প্রসঙ্গে এই অধিকার বঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক বাতিলকৃত এবং আন্দোলনরত ৮৫(পঁচাশি) জন শিক্ষক এবং তাদের ৮৫টি পরিবারের দুঃসময়ে কথাগুলো তাদের সামনে তুলে ধরেন।

তিনি তখন তদন্ত টিম তথা এডভোকেট চিকমা হুদাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, ৮৫ (পঁচাশি) জন শিক্ষকের নিয়োগাদেশ বাতিলের মাধ্যমে তাদের মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হয়েছে এবং অধিকার বঞ্চিত ৮৫ জন শিক্ষক এবং ৮৫ টি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছে।

এই ব্যাপারে তিনি ৮৫ জন শিক্ষকদের মানবাধিকার রক্ষায় এবং চাকুরী পুুুুনর্বহালে আইনী সহায়তা কামনা করেন। তখনি সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় এই অধিকার বঞ্চিত নিয়োগ আদেশ বাতিলকৃত শিক্ষকদের বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে আইনী সহায়তা দেবেন। বৈঠকের সিদ্ধান্তনুযায়ী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আইনী সহায়তা চেয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহা সচিবের বরাবরে একটি আবেদন করলে সেই আবেদনে জনাব আলহাজ্ব একে এম মকছুদ আহমেদ বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার প্যাডে রাঙ্গামাটি জেলার সভাপতি হিসাবে শিক্ষকদের মানবাধিকার রক্ষায় এবং চাকুরী পুনর্বহালে সর্বাত্মক আইনী সহায়তা চেয়ে সুপারিশ সম্বলিত পত্র লিখেন।

শিক্ষকদের আবেদন এবং জনাব মকছুদ আহমেদের সুপারিশ সম্বলিত পত্রের প্রেক্ষিতে এডভোকেট চিকমা হুদা ম্যাডাম এবং এডভোকেট এলিনা খান ম্যাডাম ৮৫ জন শিক্ষকদের পক্ষে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে মহামান্য হাইকোর্টে ১ম একটি রীট মামলা করেন এবং তাতে শুধু একজনকে চাকুরীতে যোগদান করার আদেশ দিলে পরবর্তীতে ২ মাসের মাথায় আর একটি রীট মামলা দায়ের করেন।

সেই রীট মামলার প্রেক্ষিতে মহামান্য আদালত ৮৫ জন শিক্ষককে তাদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগদানের আদেশ ও নিয়মিত হাজিরা বহিতে স্বাক্ষর করার আদেশ দেন। আর সেই আদেশে ৮৫ জন শিক্ষক আজও  চাকুরী করে যাচ্ছে। যাদের অধিকাংশই পদোন্নতি হয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

যেটা বলে শুরু করেছিলাম, তা হচ্ছে এই সেই সাংবাদিক মুর্ত প্রতীক, চারণ সাংবাদিক, দৈনিক গিরি দর্পনের প্রকাশক ও সম্পাদক জনাব একেএম মকছুদ আহমেদ শুধু সাংবাদিকই নন,তিনি একজিন নির্ভিক মানবাধিকার কর্মী। তিনি  পার্বত্যাঞ্চলের বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিক, ঐতিহ্য ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট এবং স্বোচ্ছার ছিলেন। যার কারণে জনাব একেএম মকছুদ আহমেদ পার্বত্যাঞ্চলের বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের মানবাধিকার সুরক্ষায় এক জীবন্ত কিংবদন্তী।
[লেখকঃ একজন শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী]