॥ বিহারী চাকমা ॥
গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ঠেগা, খুব্বাং,বড় হরিণামুখ, ভাল্যক্যাছড়ি, ছোট হরিণা ও ভুষণছড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সেখানে কোথাও কোন প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করেনি উপজেলা প্রশাসন। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে আশ্রয় নিচ্ছেন দুর্গত মানুষ। ছোট হরিণার জুনোপহর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরেশ সুর চাকমা জানান- ওই এলাকার সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সীমান্তবর্তী ঠেগা ও খুব্বাং এলাকার অবস্থা আরো ভয়াবহ জানিয়ে তিনি বলেন- ভয়াবহ ও বিপদজনক পাহাড়ি ঢল সবকিছু ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে প্রবলবেগে নেমে আসছে। নদী তীরবর্তী বাগান বাগিচা, ক্ষেত-খামার বসতবাড়ি সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীরোত্তম তঞ্চঙ্গ্যা জানান- উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। কেংড়াছড়িতে পাহাড় ধস হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের সহযোগিতার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ফারুয়া ইউনিয়নের জন্য ১০ মেট্রিকটন ও অন্যান্য এলাকার জন্য ১০ মেট্রিকটন খাদ্য শস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসন সুত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া ৬ দিনের টানা বর্ষণের ফলে রাঙামাটি জেলায় ছোট-বড় ভাঙ্গনসহ মোট ৩৫৯টি স্থানে পাহাড় ধসে পড়েছে। পাহাড় ধসের কারণে জেলায় মোট ৫০৬ টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এরমধ্যে আশ্রয়ণেরও ঘর রয়েছে ১৩টি। এদিকে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট প্রবল ¯্রােতে পড়ে বরকল উপজেলার মাইসছড়িতে পানিতে ডুবে এক তরুণ নিখোঁজ রয়েছেন। তাকে উদ্ধারের অভিযান চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল। মঙ্গলবার বিকালে এ তথ্য জানিয়েছেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, মঙ্গলবার পর্যন্ত রাঙামাটি জেলায় পাহাড়ি ঢলের কারণে একটি পৌরসভাসহ ২২টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লবিত হয়েছে। জেলায় মোট ২৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ হাজার ৬৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে জুরাছড়ি উপজেলায় ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি হাটবাজার, শতাধিক বসতবাড়ি প্লাবিত হবার খবর পাওয়া গেছে। জুরাছড়ি ইউনিয়নের লুলাংছড়ি, সাপছড়ি, সীতারামপাড়া, মিতিংগাছড়ি, ডেবাছড়া কুসুমছড়ি, বালুখালী, মধ্যভিটা, শীলছড়ি, ঘিলাতলী, বনযোগীছড়া ইউনিয়নের বহেরাছড়ি, ধামাইপাড়া, ছোট পানছড়ি, বেকাবেক্যা, শুকনাছড়ি, চুমাচুমি, মৈদং ইউনিয়নের পানছড়ি, ভুয়াতলী, জামের ছড়ি, হাজাছড়ি, বারাবান্যা ও দুমদুম ইউনিয়নে ডানেতেছড়ি, বস্তিপাড়া, বরকলক, করইদিয়া, চাম্পাইপাড়া, গবছড়ি প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
দুমদুম্যা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাধন কুমার চাকমা বলেন, আউশ জুমের রোপিত ধান ক্ষেতে পাহাড় ভাঙ্গার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া প্রাথমিক ভাবে ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্থ হবার খবর পাওয়া গেছে। মৈদং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাধনানন্দ চাকমা জানান, পাহাড়ি ঢল নামায় নিম্ন অঞ্চলে বসবাসরতদের আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। এছাড়া পাহাড় ধসের আশঙ্কাও বেড়েই চলছে।
জুরাছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কৌশিক চাকমা বলেন এ পর্যন্ত মৈদং ইউনিয়নের শীলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জামেরছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং জুরাছড়ি ইউনিয়নের ঘিলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হওয়ার তথ্য পেয়েছি। এছাড়া মৈদং ও দুমদুম্যা ইউনিয়নের তথ্য নেওয়া হচ্ছে।
জুরাছড়ি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ মাহফুজ আহমেদ সরকার বলেন, আউশ, আমন ও শাক-সবজি ক্ষেত ২০২ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়তে পারে।
উপজেলা চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার চাকমা বলেন, উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির এলাকা পরির্দশন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় তালিকা তৈরীর করে জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির এড়াতে পুলিশ ও উপজেলা পরিষদের একটি টিম মাঠে কাজ করছে।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী-রাঙাপানি সড়কের তপোবন আশ্রম সংলগ্ন রাস্তার একপাশে মাটি ধসে গেছে। কাপ্তাই – আসামবস্তি সড়কের বড় আাদম এলাকায়ও পাহাড় ধস হয়েছে। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাপছড়ি ইউনিয়নের দেপ্ফোছড়ি এলাকায়ও মুল সড়কের পাশে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়েছে। রাঙামাটি শহরের লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন পশ্চিম মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা হামিদা আক্তার জানান, অতি বৃষ্টির ফলে সোমবার ভোর ৫ টার দিকে তাঁর ঘরটি ধসে পড়ে । ঘর থেকে কিছু বের করতে পারেননি।
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী -রাঙাপানি সড়কের পথচারী সুমন চাকমা জানান, ২০১৭ সালে পাহাড় ধসের পর এই সড়কটি মেরামত করছিল। এখন কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি হওয়াতে আবারও সড়কটির একপাশ ধসে গেছে। সড়কটি এখন ঝুকিপূর্ণ হয়ে গেছে।
এদিকে কর্ণফুলী নদীতে তীব্র ¯্রােতে ফেরির পল্টুনের লোহার দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় সোমবার দুপুর ২টা থেকে রাঙামাটি-বান্দরবান সড়কের চন্দ্রঘোনা ফেরি পারাপার বন্ধ করেছে। পল্টুনের ছিঁড়ে যাওয়া দড়ি মেরামত ও নদীর তীব্র ¯্রােত না কমা পর্যন্ত ফেরি পারাপার বন্ধ রেখেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
সড়ক ও জনপথ রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা জানান, প্রবল ¯্রােত আর পল্টুনের সমস্যার কারণে ফেরি পারাপার আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কবে নাগাদ ফেরি চালু করা যেতে পারে সেটি আপাতত বলা যাচ্ছে না। তবে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়েই যানবাহন চলাচল করছে। কেবল ফেরি বন্ধ থাকায় এক পাড়ের যানবাহন অন্য পাড়ে যেতে পারছে না।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানান, বিগত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে অনেক জায়গায় পাহাড় ধসের সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ অতিদ্রুত সময়ে রাস্তা চলচলের উপযোগী করেছেন। রাঙামাটি জেলায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ১টি পৌরসভাসহ মোট ২২টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলা জুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দূর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের সাথে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সেচ্চাসেবক টিম কাজ করে যাচ্ছেন।