ফেসবুক পোস্টের এক নিঃস্ব মানুষের প্রতি ডিসির মহানুভবতা

865

॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥

একজন জেলাপ্রশাসকের কাজের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। আরো তিনি যদি হন পার্বত্য রাঙামাটির মতো একটি বৃহৎ এবং নানা আঙ্গিকের সমস্যা সঙ্কুল জেলার কর্ণধার; তবে তো কথাই নেই। দিনরাত কাজ করেও রাঙামাটির ডিসিরা কাজ শেষ করতে পারেন না। গত তিন দশক ধরে এমনটাই দেখে আসছি। কাজের ফাঁকেই তিনি ফেসবুকেও ঢুঁ মারেন এটা হয়তো (অধুনা প্রেক্ষাপটে) অনেকের চোখে স্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু তিনি অন্তত: ৫শ’ শব্দের একটা স্ট্যাটাস গোটাই পড়ে ফেলেছেন। এটা অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হবে। তবে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ এমন একটি স্ট্যাটাস পড়েই সাড়া দিয়েছেন একজন নিঃস্ব ভবঘুরে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা বিষয়ে।

বুধবার (০৬ ফেব্রুয়ারি) অসুস্থ মানুষটিকে নিজের পাশে বসিয়ে সব খোঁজ নিয়ে তিনি সোজাই বলে দিলেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমি বহন করবো’। শুধু মুখেই বললেন না, আবেদনের মধ্যে লিখেও দিলেন (এই লোকটির যাবতীয় চিকিৎসা খরচ জেলাপ্রশাসক, রাঙামাটি বহন করবে)। তাৎক্ষণিকভাবে ফোন করে কথা বললেন সিভিল সার্জনের সাথে, লোকটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার রোগ-বালাই সনাক্ত করার অনুরোধ জানিয়ে বললেন, বাইরে থেকে যা যা করতে হয় করাবেন, খরচ আমি দিবো।

জীবনের সবকিছু হারানো একজন অসুস্থ মানুষ এখন ভবঘুরে। নানা রোগের ডিপোতে পরিণত হওয়া এই লোকটিকে নিয়ে কয়েকদিন আগে দৈনিক রাঙামাটিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। হালের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবেদনটি দৈনিক রাঙামাটির ফেসবুক পেইজেও পোস্ট করেন সম্পাদক নিজেই। স্ট্যাটাস দেখে ফোন করে বসলেন জেলাপ্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ। বললেন, ‘আপনার স্ট্যাটাসের সেই অসুস্থ মানুষটির জন্য আমি কিছু করতে চাই। লোকটিকে কি আমার কাছে পাঠানো যাবে’? সাহায্যের বিষয়েই তো প্রতিবেদন, পাঠানো তো যাবেই।

বুধবার গণশুনানীর সময়ই হাজির হলো লোকটি। জেলাপ্রশাসকের সাহস যোগানো কথাগুলি শুনে যেন এক নিমিষেই প্রাণ সঞ্জীবনী ফিরে পেলো নির্জীব, হতাশ এবং জীবনযুদ্ধে পরাজিত ভবঘুরে আউস মিয়া। ডিসির দেওয়া সামান্য কিছু হাত খরচের টাকা নিয়ে যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে তিনি হাসপাতালের দিকে ছুটলেন; তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

শুধু আউস মিয়াই নয়; এদিন আরো অন্ততঃ ২৫জন ফরিয়াদি বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছিল জেলাপ্রশাসকের গণশুনানীতে। এর মধ্যে বেশির ভাগই- দরীদ্র শিক্ষার্থীর পিতা-মাতা। কেউ ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না টাকার অভাবে। কেউবা স্কুল ড্রেস বানাতে পারছেনা; বিদ্যালয়ে বাচ্চা মার খাচ্ছে। কারো স্কুল ব্যাগ নেই, কেউ আবার বই কেনার টাকা চান। কয়েকজন অসুস্থ দরীদ্র রুগীও এসেছিলেন ঔষধ কেনার টাকা চাইতে। কাউকে খালি হাতে ফিরতে হয়নি। সমাধান তাৎক্ষণিক, তবে সে সমাধানও যৌক্তিকভাবে এবং সত্যতার ভিত্তিতে।

গণশুনানীতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিয়ে গত কয়েক মাসে এমনিতেই রাঙামাটিবাসীদের মাঝে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন ডিসি মামুনুর রশিদ। এবার মানবতাবাদী প্রশাসক হিসেবেও এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। আউস মিয়া, তার অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য এই প্রতিবেদককে কিছু একটা বলতে চাইছিল; কিন্তু আবেগের অতিশয্যে অনেক চেষ্টাতেও সেটা তার মুখ দিয়ে বের হলো না। শুধু ছল ছল নয় তোতলাতে তোতলাতে বললিল আল্লাহ স্যারের অনেক ভালো করবেন।

আউস মিয়ার মাত্র ৩৫ বছরের অতীত জীবন অত্যন্ত করুণ এবং বেদনাময়। স্ত্রী-সন্তান, মা-সংসার সবই ছিল তার। তবে জীবনের ঘুর্ণিপাকে তিনি সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। চোখের অন্ধকার দেখা আউস মিয়া গণমাধ্যমের কাছে এসেছিলেন, মানবিক সাহায্যের বিষয়ে লিখনী চাইতে। প্রতিবেদন দেখে তার দেওয়া বিকাশ নম্বরে অনেকেই সাহায্য পাঠিয়েছেন। চুড়ান্ত কাজটুকু করে দিলেন ডিসি মামুন। এ থেকে এই বিশ্বাসটিই আবার বদ্ধমুল হলো মানবতা এখনও উজ্জীবিতই আছে এই সমাজ সংসারে।