ভূয়া সেনা কর্মকর্তাসহ বরকল থেকে আটক ১৬ জনকে জেল হাজতে প্রেরণ

361

॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥ সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয়ে বিজিবি ক্যাম্পে প্রবেশ ও সামরিক স্থাপনার গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে বরকল এবং চট্টগ্রাম থেকে আটক ভূয়া লেফটেন্যান্ট বিভাষ দেওয়ানসহ ১৬ জন জনকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছে রাঙামাটির আদালত। শনিবার তাদের রাঙামাটি চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায়। এ সময় প্রাথমিক শুনানীশেষে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন কবিরের আদালত তাদের জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। আজ রোববার রিমান্ড আবেদন শুনবেন বলে আদেশ দেন বিজ্ঞ আদালত। এই ১৬ জনের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সরকারী গোপনীয়তা আইনে মামলা রুজু করা হয়।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, বৃহস্পতিবার ভারত সীমান্তবর্তী বরকলের এসএস টিলা বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে নিজেকে সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পরিচয় দিয়ে সেখানে আতিথিয়েতা গ্রহণ করেন বিভাষ দেওয়ান নামের জনৈক পাহাড়ি যুবক। ক্যম্পের দায়িত্বে থাকা ওয়ারেন্ট অফিসার সরল বিশ্বাসে তাদের আপ্যায়ন করে ক্যাম্প ঘুরে দেখান। এ সময় তারা বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলতে থাকে। পরে তাদের গতিবিধি তার কাছে কিছুটা সন্দেহজনক মনে হলে তার উর্ধতন অফিসারকে বিষয়টি অবহিত করে ক্যাম্প দায়িত্বশীল। বিজিবি বরকল জোনের অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. আলাউদ্দিন আল মামুন জানান, আমি অবহিত হওয়ার পর তাদের ব্যপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি ওই নামে বিজিবির কোনো কর্মকর্তা নেই, পরে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে তাদের আটক করা হয়।

জানা গেছে, জোন কমান্ডার ক্যাম্প ইনচার্জ এর ফোনে সেনা অফিসার পরিচয় দেওয়া সেই পাহাড়ি যুবকটির সাথে কথা বলেন। এসময় কমান্ডার যুবককে জিজ্ঞেস করেন যে, এই নিরাপত্ত চৌকীতে অবতরণের জন্য যে পূর্বানুমতি নিতে হয়, আপনি কি তা জানেন না? বিজিবি কর্মকর্তার এই প্রশ্নের জবাবে সরি বলে লেফটেন্যান্ট পরিচয় দেওয়া যুবক তড়িঘড়ি ক্যাম্প থেকে নীচে নেমে সঙ্গীদের নিয়ে স্পীড বোটে করে চলে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। পরে বরকল সদরের বিজিবি চেকপোস্ট এলাকা অতিক্রমের সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে আটক করা হয়।

ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদকালে ভূয়া লেফটেন্যান্ট নিজেকে সিলেট ১৮ বীরে কর্মরত বলে জানান। কিন্তু সিলেটে যোগাযোগ করে জানা যায় বিভাস দেওয়ান নামে তাদের কোনো অফিসার নেই। এরপরই ওই ১২ জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে আটক করে বিজিবি। এক পর্যায়ে তাদের সাথে থাকা ব্যাগে তল্লাসী চালিয়ে সেনা অফিসারের পোশাক সাদৃশ একসেট ইউনিফর্ম, দামি ক্যামেরাসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। এদের সাথে সফরসঙ্গী হিসেবে তিনজন বৌদ্ধ ভিক্ষুও ছিলেন।

লেফটেন্যান্ট পরিচয়দানকারী যুবকের নাম বিভাস দেওয়ান, তার পিতার নাম-বি কে দেওয়ান, মাতার নাম কনিকা দেওয়ান, সাং- বিজন স্মরনী, থানা কোতয়ালী। আটক অপর ১১ জন হলো- রিটেন চাকমা(২২) সুনীতি বিকাশ চাকমা (২১) রিপেন চাকমা (২৫) রিগেন চাকমা (১৮) ছন্দ সেন চাকমা (৩৫) মুক্তবীর চাকমা (২২) রুহিত চাকমা (২১) জ্যাকশন চাকমা (২০) শ্রীমৎ বুদ্ধজ্যাতি শ্রমণ (২০) গিরিমান্দ ভিক্ষু (৩৫) ও শান্তপ্রিয় ভিক্ষু (৩৮)। আটকদের মধ্যে রাঙামাটি সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত রয়েছে ৫ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে একজন, চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে একজন। বাকিদের মধ্যে বৌদ্ধ ভান্তে রয়েছেন তিনজন, বাকি একজন ফটো সাংবাদিক। তাদেরকে শুক্রবার রাতেই বরকল থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয় বলে জানান বরকল থানার অফিসার ইনচার্জ নিলু কান্তি বড়–য়া।

পরে বিভাসের স্বীকারোক্তি অনুসারে তার চট্টগ্রামের বাসায় অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীর র‌্যাংক ব্যাজসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহস দামি দুইটি ল্যাপটপ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তুরের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।  এ সময় বাসা থেকে চারজন আরো চার যুবককে আটক করে যৌথবাহিনী। এরা হলো-রিটেন চাকমা (২২) জ্ঞান লাল চাকমা (২১) স্মৃতি বিকাশ চাকমা (২৫) ও সোহেল চাকমা(২২)।

বিজিব সূত্রে জানা গেছে, বরকলে আটককৃতদের কাছ থেকে ২২টি মোবাইল ফোন, ৩টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা ছাড়াও নতুন মডেলের সেনা পোশাক-৩ জোড়া, ওয়ার্কিং ড্রেসের জার্সি-১টি, বিএমএ ক্যাডেটদের ব্যবহৃত হ্যান্ড ব্যাগ-১টি, অফিসার এসডি পোশাক-১ জোড়া, বীর রেজিমেন্টের গ্রীণ ক্যাপ-১টি, র‌্যাংক ব্যাজ ২ লেঃ বীর-২ পেয়ার, র‌্যাংক ব্যাজ লেঃ বীর-১ পেয়ার, অফিসার মেসকীট-১ পেয়ার, বিভিন্ন ডিবিশনের ডিভ সাইন-৮টি, কমান্ড ব্যাজ-২টি, বিভাস লেখা নেইম প্লেট-২টি, ডিএমএস বুট-১ জোড়া, পিটি-সু-১ জোড়া, কালো মুজা-১ জোড়া, বেল্ট-১টি, কম্ব্যাট গেঞ্জি-১টি, প্যারা উইং গ্রীণ কালার-১টি, এ্যামোনেশন উইং-১টি, বিভাস লেখা অফিসার পরিচয় পত্র-১টি, ৭৪তম বিএম লং কোর্সের ক্রেষ্ট-১টি, ডেল কোম্পানীর ল্যাপটপ-১টি, এইচপি কোম্পানীর ল্যাপটপ-১টি, রিবন-২টি, মেডেল-২টি, চেতনা ও মূল্যবোধের কার্ড-১টি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী লেখা স্টিকার-৩টি।

রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাতে আটককৃতদেরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে যৌথবাহিনী। তিনি জানান, সামরিক স্থাপনায় গিয়ে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা-ছবি তোলা, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদান করা এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধন করার উদ্দেশ্যে অর্ন্তঘাতমূলক কর্মকান্ডের প্রচেষ্টা চালানোর অপরাধে আলাদা দুইটি মামলা দায়ের করা হয়।

নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টিকে অতীব গুরুত্ব দিয়ে টানা দুইদিন সময় নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আটককৃতদের মধ্য থেকে বিভাস চাকমাসহ আরো কয়েকজন বিদেশী রাষ্ট্র থাইল্যান্ডের একটি সংস্থার হয়ে গুপ্তচর বৃত্তির সাথে জড়িত। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সেনা ক্যাম্পে গিয়ে সেনা বাহিনীর অফিসার পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পগুলোর ভৌগলিক অবস্থানের ছবি ও ডাটা সংগ্রহ করাই ছিল তাদের কাজ। সংগৃহীত এসব ডকুমেন্ট পরবর্তীতে তুলে দেওয়া হতো থাইল্যান্ডের সেই গ্রুপটির হাতে। এছাড়া এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাথে বাইরের বেশ কয়েকটি দেশের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। এসব কাজ সমন্বয় করতো আইটি বিষয়ে এক্সপাট বিভাস দেওয়ান।

একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ২৭ শে জানুয়ারী রাঙামাটি সদরস্থ ফুরোমোন বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে সেখান থেকেও পাশ্ববর্তি সেনা ক্যাম্পে গিয়েছিলো এই দলটি। সেখানেও বিভাস দেওয়ান নিজেকে সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ছবি তুলেন এবং কিছুক্ষণ অবস্থান করেন।