॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥
তিন পার্বত্য জেলায় সংবাদিকতার পথিকৃত ও গণমাধ্যম জগতের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত এ কে এম মকছুদ আহমেদকে একুশে পদক প্রদানের মাধ্যমে জাতিকে দায়মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে লংগদু উপজেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ ও সুধীজন। রবিবার (২৭ ডিসেম্বর) মকছুদ আহমেদের সাংবাদিকতার ৫০ বছর পূর্তি ঘিরে আয়োজিত সংবর্ধনায় এ আহ্বান জানান বক্তারা। লংগদু প্রেসক্লাবের উদ্যোগে এই সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখার সময় লংগদু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বারেক সরকার বলেন, একেএম মকছুদ আহমেদ জাতির কল্যাণে এবং পাহাড়ের মানুষের শান্তির জন্য নিজের জীবন যৌবন বিলিয়ে দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। আজকে- পাহাড়ে যেটুকু উন্নয়ন হচ্ছে, তা সম্ভব হয়েছে শান্তির বাতাবরণে। আর এই শান্তি প্রতিষ্ঠার পিছনে যারা কাজ করেছেন, সাংবাদিক মকছুদ আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তাই তার প্রতি আমাদের অনেক দায় রয়েছে, আজকের সংবর্ধনার তারই অংশ।
সভাপতির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাইনুল আবেদীন বলেন, ৭১ এর এই ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানীদের দোসর রাজাকারদের চক্রান্তে আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে এই জাতিকে মেধাশূণ্য করার চক্রান্ত করা হয়েছিল, কিন্তু সে চক্রান্ত সফল হয়নি, মাকছুদ আহমেদের মতো ব্যক্তিত্বরা আমাদের সেই শূণ্যস্থান অনেকটাই পুরণ করে দিয়েছেন। ইউএনও বলেন, তিনি জাতির জন্য কাজ করে জাতিকে দায়বদ্ধ করেছেন; সেই দায়মুক্ত হওয়ার জন্যই তাঁকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান ও পুরস্কৃত করা একান্ত প্রয়োজন। ইউএনও বলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাঙামাটি জেলার জেলাপ্রশাসক মহোদয় ইতোমধ্যেই মকছুদ সাহেবকে একুশে পদক প্রদানের সুপারিশ করেছেন। এ বিষয়ে জাতীয় কমিটির কাছে আমিও বিনীত নিবেদন করছি যে, তাঁকে যেন বাছাইয়ে রাখা হয়।
তিনি আরো বলেন, একটি চিরন্তন বাণী রয়েছে- যে দেশের গুণীর কদর হয় না, সেখানে গুণী জন্মায় না। মকছুদ সাহেব সম্পর্কে আমি যতদূর জানতে পেরেছি, আজকের এই সময়ে তিন পার্বত্য জেলায় যারা সাংবাদিকতা করছেন তিনি তাদের সকলের গুরু। তিনি মহৎ মানুষ বলেই পাহাড়ের মানুষের কল্যাণে অর্ধ শতাব্দী ধরে নিস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন।
উপজেলা চেয়ারম্যান তার বক্তব্যে আরো বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে সারাদেশে অকল্পনীয় উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তা-ঘাট-ব্রীজ কালভার্টসহ নানা অবকাঠামো তৈরী হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সারাদেশের ৬৩ জেলার তুলনায় পাহাড়ের উন্নয়ন নিতান্তই সাধারণ। আবার পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে উন্নয়নে রাঙামাটির অবস্থার আরো তলানীতে। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের তাদের লেখনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীসহ বড়বড় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী পাহাড়ের বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক, তবে তিনি সারাদেশের খোঁজ খবর রাখতে গিয়ে হয়তো জানতে পারছেন না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের গতি অত্যন্ত ক্ষীণ। আপনারা এই বন্ধাত্ব ঘোচাতে লেখালেখি করুন। পাহাড়ের মানুষ আপনাদের সহযোগীতা চায়।
সংবর্ধিত অতিথি একেএম মকছুদ আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, সেই সময়ের পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্যই আমি চাকুরি ছেড়ে সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেছিলাম। নানা অভাব অনটনের মাঝেও অনেক কষ্টে আমি প্রায় চারদশক ধরে দৈনিক গিরিদর্পণ প্রকাশ করে যাচ্ছি। এই পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে আমি পরিবারের অনেক সম্পদ নষ্ট করেছি। অভাব অনটনে সংসার চালিয়েছি। তবে অভাবে থাকলেও আমি নিজের স্বভাব নষ্ট হতে দেইনি। কখনও মিথ্যা বা বানোয়াট রিপোর্ট প্রকাশ করে জাতিকে বিভ্রান্ত করিনি। আমি চাইলে সত্য গোপন করে জীবনে অনেক সুবিধা অর্জন করতে পারতাম। কিন্তু মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে আমি সব সময় সত্যের স্বপক্ষে সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন করেছি। কারণ আমার নীতি হলো বস্তুনিষ্ঠ নয় বরং সঠিক তথ্য উপস্থাপন।
রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সভাপতি সাখাওয়াৎ হোসেন রুবেল তার বক্তব্যে বলেন, মকছুদ ভাই পাহাড়ে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন বলেই হয়তো আজ আমরা জাতির কল্যাণে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি শুধু সাংবাদিকতাই নয়, পাহাড়ের শান্তির জন্য, উন্নয়নের জন্য সব সময় কাজ করেছেন। রাঙামাটিতে প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। পাহাড়ের মানুষের দাবি তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হোক।
লংগদুর অফিসার ইনচার্জ আরিফুল আলীম বলেন, রাঙামাটিতে চাকুরী করতে এসে আমি ওনার কথা অনেক শুনেছি। আজ সুধীজনের মুখে আরো শুনলাম; ওনাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল । আজ সে সৌভাগ্য হলো। এমন ব্যক্তিত্বকে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করা না হলে আর কাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে?
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক রাঙামাটি সম্পাদক আনোয়ার আল হক বলেন, মকছুদ ভাইকে আমরা গণমাধ্যম জগতে পাহাড়ের বাতিঘর হিসেবে চিনি। তিনি শুধু সাংবাদিকতাই নন পাহাড়ের সাতিহ্য সংস্কৃতির উন্নয়নে অনন্য অবদান রেখেন। রাঙামাটি প্রকাশনী ছিল বলে পাহাড়ে অনেক কবি সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে, প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রাঙামাটি প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করে মকছুদ ভাই অনেক সাধারণ মানুষকে জাতীয় স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন। তিনি পাহাড়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম নায়ক এবং পাহাড়ের মানুষের জন্য একটি আদর্শ। আমরা তার স্বীকৃতি চাই, ওনার জন্য জাতীয় পুরস্কার চাই।
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা যখন পত্রিকা চিনতে শুরু করেছি, তখন থেকে চিনেছি দৈনিক গিরিদর্পণকে। ওই পত্রিকাতেই আমাদের কথাগুলো প্রকাশ হতো বলে আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম কখন গিরিদর্পণ পড়বো। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ জানে মকছুদ সাহেব একজন সৎ ও নির্ভিক সাংবাদিক।
মকছুদ আহমেদ তার বক্তব্যে আরো বলেন, পাহাড়ের উন্নয়ন ও স্থায়ী শান্তি আনায়নে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় পার্বত্য তিন জেলাকে ৭টি জেলায় বিভক্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে নতুন বিভাগ করার ঘোষণার দাবিসহ পাহাড়ের বেশ কিছু সমস্যা অনেকদিন ধরেই আমি লিখে যাচ্ছি, এখন সময় হয়েছে এই দাবিকে গণদাবিতে পরিণত করার।
রবিবার (২৭ ডিসেম্বর) দুপুরে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলা প্রেসক্লাবের আয়োজনে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একই সাথে ‘পাহাড়ের সংবাদপত্র ও প্রকাশনা সমাচার’ বইয়ের মোড়ক উম্মোচন করা হয়।
অনুষ্ঠানে পাহাড়ের চারণ সাংবাদিক রাঙ্গামাটির দৈনিক গিরিদর্পণ সম্পাদক ও দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি এ,কেএম মকছুদ আহমেদের সাংবাদিকতার ৫০ বছর পূর্তিতে উপজেলা প্রশাসন ও লংগদু প্রেসক্লাব সংবর্ধনা প্রদান করে।
উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাইনুল আবেদীনের সভাপতিত্বে সংবর্ধনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন লংগদু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল বারেক সরকার। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন লংগদু থানার অফিসার ইনচার্জ আরিফুল আমিন, রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাবে সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রুবেল, রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাবে সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক রাঙামাটি সম্পাদক আনোয়ার আল হক। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ঝান্টু, গুলশাখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ আবু নাসির ও আটারকছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন লংগদু প্রেসক্লাব সভাপতি মোঃ এখলাস মিয়া খান।
বক্তব্য পর্বশেষে অতিথিরা সংবর্ধিত অতিথি চারণ সাংবাদিক দৈনিক গিরিদর্পণ সম্পাদক ও দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি এ, কে, এম মকছুদ আহমেদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। এ সময় আরো দুটি সংগঠন তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে সম্মাননা প্রদান করে। শেষে এ,কেএম মকছুদ আহমেদের জীবনী নিয়ে রচয়িত গ্রন্থ “পাহাড়ের সংবাদপত্র ও প্রকাশনা সমাচার” বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
লংগদুর সাংবাদিক আরমানের উপস্থাপনায় এ অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, লংগদু মডেল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শহীদুল্লাহ কায়সার, বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া এতিম খানার সুপার মাওঃ ফোরকান, রাঙামাটি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি নন্দন দেবনাথ, রাঙামাটি প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ পুলক চক্রবর্তী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ ও লংগদু প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক মুছাসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।