মানিকছড়ি দিয়ে জ্বালানী কাঠের আদলে পাচার হচ্ছে সংরক্ষিত বনের চারা গাছ

597


॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥
প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাঠ পাচারের অন্যতম পয়েন্ট রাঙামাটির মানিকছড়ি থেকে চলতি মৌসুমেও থেমে নেই কাঠ পাচার। জ্বালানী কাঠের নাম করে ৫ জনের অসাধু ব্যবসায়ীর একটি সিন্ডিকেট কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার চারা গাছ পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সংশ্লিষ্ট সকলের চোখের সামনে দিয়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে এসব কাঠ জ্বালানী কাঠের নামে চলে যাচ্ছে জেলার বাইরে। জানা গেছে এই সিন্ডিকেটটির এবারের টার্গেট কুতুকছড়ি রেঞ্জের বিক্রয় ও কর্তন নিষিদ্ধ প্রাকৃতিক বনজ গাছ। ইতিমধ্যেই এই সিন্ডিকেট এর মাধ্যমে কুতুকছড়ি রেঞ্জের আওতাধীন অনেকগুলো এলাকার প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে রাঙ্গুনিয়া-রাউজানের ইটভাটাগুলোতে অবাধে পাচার করা হয়েছে হাজার হাজার চারা গাছ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের এই সময়টাতে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় মানিকছড়িতে নৌ-যান চলাচল সম্পূর্নরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে কয়েক মাস পর্যন্ত উক্ত এলাকা থেকে জ্বালানী কাঠভর্তি কোনো গাড়ি যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও মানিকছড়ি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪৫টি পর্যন্ত জ্বালানী কাঠভর্তি গাড়ি রাঙ্গুনিয়া-রাউজানের ইটের ভাটাগুলোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার অবস্থা। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটির বনবিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজসে মানিকছড়ির ৫ থেকে সাতজনের প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে জুম নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অধীনস্থ কুতুকছড়ি-ঘিলাছড়ির বনাঞ্চলের চারা গাছগুলো কেটে জ্বালানী কাঠের নাম করে পাচার করা হচ্ছে অবাধে।
সরেজমিনে গিয়েও এমনই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বেলা ১২ টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সময়ে কুতুকছড়ির নিকস্থ খামার পাড়া, বোধিপুর, ও কেসিং এই তিন এলাকা থেকে কাঠ ভর্তি করে একের একের জীপ গাড়ি মানিকছড়ির মুখে অবস্থান করে। পরে সেখান থেকে টিপি প্রদর্শন করে অন্তত দু’শফুট জ্বালানী কাঠভর্তি প্রতিটি জীপ গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে ইটভাটার গন্তব্যে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়িদের সাথে কথা বলতে গেলে তারা জানান, ‘আমরা বনবিভাগ থেকে বৈধভাবে টিপি সংগ্রহ তার মাধ্যমেই ব্যবসা করছি। বৈধ ব্যবসায়িদের অনেকেই জানিয়েছেন, সদর রেঞ্জের অথরীটিতে এই রুট থেকে জ্বালানি কাঠ ভর্তি জীপ গাড়ি ছাড়ার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজসে বিপুল পরিমান চারাগাছ কর্তন করে জ্বালানী কাঠ হিসেবে পাচার করা হচ্ছে বৈধতা দিয়ে।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বনবিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া জানান, আমরা বিসিক শিল্পনগরী মাঠ থেকে জ্বালানী কাঠ পরিবহনের জন্যে টিপি বরাদ্ধ দিয়েছি। তিনি জানান, আমরা প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫টি টিপি দিয়ে থাকি।
বনবিভাগ সূত্রে জানাগেছে, প্রতিটি টিপি’র বিপরীতে জ্বালানী কাঠ নেওয়ার নিয়ম রয়েছে ৮০ সিএফটি। কিন্তু মানিকছড়ি চেকপোস্ট দিয়ে অতিক্রম করা জীপগুলোতে ১৭০ থেকে ২শ’ ফুট পর্যন্ত জ্বালানী কাঠ ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্বত্য জেলা রাঙামাটির অন্যতম প্রবেশ মুখ মানিকছড়ি হচ্ছে কয়েকটি রুটের মিলনস্থল। এই রুটটি দিয়ে পাচার হওয়া জ্বালানী কাঠবাহি জীপ গাড়িপ্রতি চাঁদা হিসেবে আদায় করা হয় ৪ হাজার ৬শ’ টাকা করে। সংশ্লিষ্টদের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে চলা ৭ জনের সিন্ডিকেট চক্র এসব ক্ষুদ্র জ্বালানী কাঠ ব্যবসায়িদের কাছ থেকে গাড়ি প্রতি এই টাকাটি আদায় করে। তাদের হিসেব মতে আদায়কৃত এই টাকার একটি বড় অংশই(১৮০০/১০০০) আঞ্চলিক প্রধান দু’টি দলকে দিতে হয়। এছাড়াও আরো অন্তত সাতটি খাতে যথাক্রমে, ৫০০, ১০০, ৩০০, ৫০০, ১০০, ১০০, ২০০শত টাকা মিলে সর্বমোট ১৮শ টাকা। এই বিষয়ে জানতে সাপছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রিটন বড়–য়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, আমি এসব ব্যবসার সাথে জড়িত নই।
অপরদিকে মানিকছড়ি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোঃ ইউছুপ বলেন, আমাদের পুলিশের কেউ এই ধরনের টাকা-পয়সার ব্যাপারে জড়িত নয়। এই বিষয়টি নিয়ে আমার কাছে কোনো তথ্যও নেই। এদিকে, স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কুতুকছড়ির কেসিং, খামার পাড়া, বোধিপুরসহ আরো কয়েকটি এলাকায় ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার মন চারাগাছ মজুদ করে রেখেছে সেই একই সিন্ডিকেট চক্র।
জানা গেছে, স্থানীয় সিন্ডিকেট চক্র কর্তৃক অবৈধভাবে জ্বালানী কাঠ মজুদ করে রাখলে সেখানে বনবিভাগ কর্তৃক অভিযান পরিচালনা করে সেসব কাঠ পরবর্তীতে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করার নিয়ম রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বনবিভাগ বিশেষ কাগজ টিপি ইস্যু করে। এই টিপির মাধ্যমেই প্রতিটি জ্বীপ বা চাঁদের গাড়িতে করে সর্বোচ্চ ৮০ সিএফটি জ্বালানী কাঠ পরিবহন করতে পারে সংশ্লিষ্ট টিপি বহনকারি ব্যবসায়ি। কিন্তু বর্তমানে মানিকছড়ির বিসিক এলাকাকে দেখিয়ে বরাদ্ধকৃত টিপির বিপরীতে উক্ত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে কোনো কাঠের অস্থিত্বই খুঁেজ পাওয়া যায়নি। দেখাগেছে সেই খামার পাড়া, বোধিপুর ও কেসিং এলাকা থেকে এই ১৭০ থেকে ২২০ সিএফটি কাঠ ভর্তি জীপ গাড়িগুলো তথাকথিত টিপি প্রদর্শন করে নিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই অত্রাঞ্চলের পাহাড়গুলো ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হবে।