যুদ্ধকালীন সময়ে রাঙামাটির স্মৃতিমন্থন চার মুক্তিযোদ্ধার

740

 

॥ মঈন উদ্দীন বাপ্পী ॥

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্বত্য রাঙামাটির যুদ্ধাকালীন স্মুতি রোমন্থন করেছেন চার বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৭ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অনুষ্ঠানে যোগদান করতে এসে বিশেষ সাক্ষাৎকারে এই চার বীর মুক্তিযোদ্ধা দৈনিক রাঙামাটিকে এই সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দীন পেয়ারা:

বাংলার স্বাধীনতার রণাঙ্গনের বিশ্বস্থ সৈনিক শামসুদ্দীন । জীবনের মূল্যকে উপেক্ষা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলের মৃত্যুর সাথে মিতালী করতে। পিতার চাকরীসূত্রে রাঙামাটিতে জন্ম হয়েছে। লেখাপড়া করেছেন এ জেলার সবচেয়ে পুরনো বিদ্যালয়ে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ে লেখা-পড়ার পাঠ চুকিয়ে পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭ ডিসেম্বর রাঙামাটি হানাদার মুক্ত দিবসে চোখের চশমা মুছতে মুছতে অতীত স্মৃতিতে বারংবার হারিয়ে যাচ্ছেন এ মুক্তিযোদ্ধার। স্বাধীনতা পরবর্তী সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেচে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছেন।
একটু নি:শ্বাস, অপলক দৃষ্টিতে বলতে লাগলেন, ইতিহাসের চির সত্য গল্প। আজকে সেই দিনের মতো ঘন কুয়াশা নেই, শীতের প্রখরতা নেই। কিন্তু মনে হয় এখনো এসএলআর নিয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে আছি শত্রুকে ধ্বংস করবো বলে। কিন্তু সময় বসে নেই পার হয়ে গেছে দীর্ঘ ৪৫ বছর। আজ অনেক কিছু বদলে গেছে। হিসাবটা মিলাতে অনেক কষ্ট হয়। এ বীর মুক্তিযোদ্ধার এমন শব্দ চয়ন শুনে শুনসান নিরবতা উন্নয়ন বোর্ডের হল।

বলতে লাগলেন, বিএলএফ এর হয়ে কয়েকশো যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য ভারতের প্রদেশ মিজোরামের দেমাগ্রী গেছে ট্রেনিং করার জন্য। আর এ ট্রেনিংয়ে পরিচয় হয় রাঙামাটি আরেক কৃতি সন্তান রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছাত্র মনীষ দেওয়ানের সাথে।

বিএলএফ এর নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি এবং এ সংগঠনের কমান্ডার ছিলেন, ভারতীয় জেনারেল সুজান সিং উবান। আর সুজান সিংয়ের নেতৃত্বে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। প্রশিক্ষণ শেষে ভারত হয়ে রাঙামাটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা। এ বীর মুক্তিযুদ্ধা জানান, ৮-১০মাইল কয়েকবার পথব্রজ করে রাঙামাটিতে আসলেও কমান্ডার সুজান সিং উবানের নির্দেশে প্রথম হেলিকপ্টারে করে রাঙামাটিতে আসি শত্রু সেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল মনীষ দেওয়ান :

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ বক্তব্য শুনে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে থাকতে পারেনি। রণাঙ্গনে যুদ্ধের জন্য ১৯ বছর বয়সে জীবনের মায়া ত্যাগ করে ট্রেনিংয়ের জন্য মিজোরামের দেমাগ্রিতে পাড়ি জমিয়েছেন। আবেগ আপ্লুত হয়ে ১৭ ডিসেম্বর রাঙামাটি হানাদার মুক্ত দিবসে এভাবেই অভিব্যক্তি ব্যক্ত করছিলেন ৬৫ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল মনীষ দেওয়ান।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি নয়। সঠিক ইতিহাসকে কেউ বিকৃতি করবেন না। বলতে লাগলেন কিভাবে রাঙামাটি হানাদার মুক্ত হয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দীন জন্মসূত্রে রাঙামাটির সন্তান হলেও আমার সাথে পরিচয় ছিলো না। সেই পড়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার সময় পরিচয়ের মিতালী। ভারতীয় সৈনিকরা রাঙামাটিতে পাকিবাহিনীর উপর হামলা করার জন্য আমাকে এবং বন্ধু শামসুদ্দীনের উপর দায়িত্ব অপর্ণ করে।

কমান্ডার সুজান সিং উবান আমাদের বলতে লাগলেন তোমরা একদিকে যেমন যুদ্ধা তেমনি সৈনিকদের পথ প্রদর্শক। তোমাদের হেলিকপ্টারে করে রাঙামাটির কুতুকছড়িতে যেতে হবে। আর সেই যুদ্ধে আমাদের কমান্ডার ছিলেন, ভারতীয় মেজর সুরী।

১৫ ডিসেম্বর যখন মেজর সুরীসহ হেলিকপ্টারে করে ভারতের দেমাগ্রী হয়ে রাঙামাটির উদ্দেশ্য সকাল সাড়ে ৯টায় রওনা হলাম তখনি আমাদের হেলিকপ্টারে পাকিস্তানী বাহিনীর গুলি বর্ষন করলে আমাদের হেলিকপ্টার আক্রন্ত হয়। কিন্তু তারপরও হেলিকপ্টার আমাদের কুতুকছড়িতে নামিয়ে দিয়ে আরও সৈন্য আনতে চলে গেল। তথক্ষণে পকিস্তানী বাহিনী কুতুকছড়িতে প্রবেশ করলো।

সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে আমাদের লড়াই হলো। সন্ধ্যার পর যুদ্ধ থামলো। ১৬ ডিসেম্বর সকালে কুয়াশার জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। মেজর সুরী ও আমরা যখন পরিস্থিতি দেখার জন্য বের হলাম তখনি আবার পাকিস্তানী বাহিনীর গুলি বর্ষণ করতে লাগলো। দিন পেরিয়ে বিকেলে আমি আর শামসুদ্দীন কাউখালীর উদ্দেশ্য পুরোমন পাহাড় পাড়ি দিয়েছি। পাহাড়ে চাকমাদের ঘরে রাত কাটিয়েছি।

১৭ ডিসেম্বর সকালে কাউখালীতে পৌছলে সাধারণ মানুষেরা বলাবলি করছে রাজাকার, পাকিস্তানী বাহিনীরা পালিয়ে গেছে।

তখনি সিএন্ডবির একটি গাড়িতে আমি বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দীন উঠে রাঙামাটিতে প্রবেশ করার সময় দেখা হয় পথে কলেজ গেইট এলাকায় মোটর বাইক নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে মেজর সুরি। ব্যস্ত শত্রু সেনাদের খুঁজে বের করতে।
এদিকে সড়কে সাধারণ মানুষদের দৌড়াদৌড়ি। আমাকে এক পলক দেখতে পাহাড়ি-বাঙালী মানুষের ঢল। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি চারণ করছেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি বলতে লাগলেন অনেকে ইতিহাসকে বিকৃতি করার জন্য ১৮ ডিস্মেবর রাঙামাটি হানাদার মুক্ত দিবস বলে বেড়ায় অথচ ১৭ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন প্রাঙ্গন বর্তমানে উন্নয়ন বোর্ড এলাকা থেকে আমি স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করি। ১৮ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে শেখ ফজলুল হক মণি,এসএম ইউসুফ, শেখ সেলিম, আমাদের কমান্ডার সুজান সিং ওভান আসেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অশোক মিত্র কার্বারী:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করা এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বড্ড অভিমানী । দেশ ছেড়ে ভারতে স্থায়ী হয়েছেন বহু বছর ধরে। কর্ণেল মনীষ দেওয়ানের অনুরোধে আজকের দিনটির জন্য ভারত থেকে ছুটে এসেছেন নিজের জন্মভূমি রাঙামাটিতে।

যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্মরণ করলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দেশের জন্য অকাতরে শহীদ হওয়া সেসব বীর যোদ্ধাদের।

কন্ঠে অভিমানীর সুরে বলতে লাগলেন ৪৫ বছর কিছু বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি। ৪৫ বছরের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবো না। অসহায় মূহর্তে কিছু বলার সুযোগ পেয়েছি এটাই কম কিসের। বলতে শুরু করলেন কিভাবে তার পরিবারদের পাকিস্তানী সৈনিকরা অত্যাচার করেছে।শুরু করলেন, রণাঙ্গণের গল্প।

১৯৭১ সালের ৭ই জুলাই আমি যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিতে মিজোরামের দেমাগ্রীতে চলে যায়। আমাদের ৪০০জনের একটি দল যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিয়েছি। আমাদের ট্রেনিং দিয়েছে চীন ও পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করা অভিজ্ঞ ভারতীয় অফিসাররা। আর আমাদের দেখভাল করতেন ইস্ট বেঙ্গলের নায়েক সুবেদার খায়রুল ইসলাম।

ট্রেনিং শেষে ১৬ অক্টোবর ভারতের দেমাগ্রী থেকে ৪০জনের একটি প্লাটুন নিয়ে রাঙামাটিতে আসার সময় পথ হারিয়ে দীর্ঘ সময় পর বরকলের হরিণায় পৌছি দুপুর ১২টায়। কিন্তু বেলুচ বাহিনী হরিণা বাজারে আসে সকাল ৯টায়। আমরা ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে আমাদের ইনচার্জ কর্ণেল নন্দন লাল-কে এ বিষয়ে জানায়। কিন্তু কর্ণেল বলতে লাগলেন, যে যুদ্ধ ছাড়া ফিরে আসবে তাকে এখানে গুলি করে মারা হবে।আমরা পুরো প্লাটুন এ্যাম্বুসে এক মিনিট ফায়ার করে পাকিস্তানী বাহিনীদের জানান দিয়ে আমরা পুণ:রায় দেমাগ্রীতে চলে গেলাম।

পরবর্তীতে আমাকে কমান্ডার বললেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে চট্টগ্রামে চলে যাও। আমাকে দুই প্লাটুন ৮০জনের একটি দল দেওয়া হলো। কমান্ডার বলতে লাগলেন কে কি হাতিয়ার নিচ্ছো আমাকে জানাবে। সেদিন আমরা টুইস মর্টার, ফ্রেঞ্চেজ গ্রেনেড,এক্সক্লুসিব এবং এলএমজি অস্ত্র নিয়ে বান্দরবান হয়ে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা আক্রন্ত হয়। আমাদের অনেক সৈনিক সেদিন শহীদ হোন।

বান্দরবান হয়ে চট্টগ্রাম জেলার রাঙুনিয়ার সড়ক ভাটায় উপস্থিত হলাম। সেখানে পৌছে আমরা একজনের গোয়াল ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করি। আমাদের থেকে মাত্র দুই কি:মি: দূরে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থান। পাকিস্তানী বাহিনীরা আমাদের আসার খবর শুনে বান্দরবান,চন্দ্রঘোনা হয়ে আমাদের উপর হামলা চালালে আমাদের ১৫জনের একটি দল বান্দরবন মুখে পাকিস্তানীদের উপর পাল্টা হামলা চালায়।

আমার কাছে খবর এলো ১৩ ডিসেম্বর চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে অবস্থানরত পাকিস্থানী বাহিনীর উপর হামলা চালাতে হবে। আমরা ১৩ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে হামলা চালায়। সকল পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করি। আমারা পেপার মিল দখল করে নিই।

তিনি বলেন, রাঙুনিয়ার সড়ক ভাটায় ১৬ ডিসেম্বর আমার নেতৃত্বে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিলো। ১৮ডিসেম্বর রাঙামাটিতে আমার আসা হয়। মেজর জেনারেল সুরী সিং এর হাতে অস্ত্র জমা দিয়। অভিমানী কন্ঠে বলতে লাগলেন,যখন ৪০ বছরের কোন যুবক আমাকে মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে সনাক্ত করতে আসে তখন এতো লজ্জা রাখি কোথায়। তিনি বলেন, আমাদের স্থান দিলে দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা:

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ বাদ দিয়ে সরাসরি ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের এক হাত দেখিয়ে দিলেন। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য বলতে লাগলেন, আপনারা আপনাদের সন্তানের কাছে কি জবাব দিবেন। যখন ধরা পড়বেন,জেল খাটবেন।

তিনি বলতে লাগলেন, আমি সবসময় বিবিসি রেডিও শুনতাম।একদিন রেডিওতে বলতে লাগলো সত্যিকারের ইতিহাস কেউ লুকিয়ে রাখতে পারে না। ৫০বছর পরও সত্যিকারের ইতিহাস বেরিয়ে আসবে।

তিনি আরও বলেন,অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলতে শুনি আমার সাথে যুদ্ধ করেছি। কি আশ্বর্য যারা এসব কথা বলে তারা আমাকে সামনে দেখলেও চিনে না। অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে ভারতে নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অথচ ভারতীয়রা কখনও থ্রি নট থ্রি রাইফেল ব্যবহার করতো না। লজ্জা লাগে সত্যিকারের ইতিহাস বিকৃতি করছে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধারা।

রাঙামাটিতে জন্ম,শৈশব,যৌবন কাটালেও ছাত্রলীগের সাবেক এ নেতা জীবনের বাকি সময় কাটাচ্ছে খাগড়াছড়ি জেলাতে। এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, কোথায় থেকে শুরু করবো। শুরু করতে হলে সেই ২৫ই মার্চ থেকে শুরু করতে হবে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এভাবেই তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন হানাদার মুক্ত দিবসে।