(২ম পর্বের পর)
১৯৭১ সাল’র মে মাসের ২ বা ৩ তারিখ সকালে একদল পাকিস্তান সেনাবাহিনী’র সৈন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার’র একটা চিঠি নিয়ে মুরাদনগর থানায় আসেন। চিঠিতে আদেশ ছিলো থানার সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেন পুলিশ লাইনে চলে যায় উল্লেখ্য ওই চিঠিতে বিশেষ করে হিন্দুদের অশ্যই পুলিশ লাইনে যাওয়ার আদেশটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা ছিলো।
এরপর তারা সবাইকে রতন চাকমা সহ একটি গাড়িতে করে প্রথমে পুলিশ লাইনে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে সবাইকে নামিয়ে দেয়া হয়। তারপর আরেকটি গাড়িতে করে, সার্কেল ইন্সপেক্টর শহীদ খগেন্দ্রলাল চাকমা, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী, সেকেন্ড অফিসার তোরাব আলী, এএসআই গঙ্গারাম চৌধুরী, কনস্টেবল প্রতাপচন্দ্র সিংহ সহ আরো কয়েকজ কে নিয়ে গাড়িটি কুমিল্লা সার্কিট হাউজ’র দিকে রওনা দেয়। ওইদিনই রতন চাকমা’র ওনার বাবাকে শেষবার দেখেছিলেন।
তিনি আর ফিরে আসেননি, তিনদিন পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী সহ কয়েকজ পুলিশ লাইনে ফিরে আসেন, রতন চাকমা’র ভাষ্যমতে মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী কে দেখে চেনা যাচ্ছিলো না, ওনাকে যে প্রচুর নির্যাতন করা হয়েছিলো তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। রতন চাকমা মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী কে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন বাবা কোথায় উনি আসেনি কেন, বাকি চাচারা ও বাবা কখন ফিরবেন? কিন্তু মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী তাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরেন আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ওনার চোখ দিয়ে শুধু গড়গড়িয়ে পানি ঝড়ছিলো, আর বলেছিলো তোমার বাবা ফিরে আসবেন ।
এতেই রতন চাকমা বুঝে ফেলেন তার বাবা আর নেই। কিন্তু ছেলে’র মন বাবা’র এ আকস্মিক মৃত্যু মানছিলো না। তাই সে তার বাবা’র ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলো। বাবা’র কিন্তু দিন যাচ্ছিলো শহীদ খগেন্দ্রলাল চাকমা আর ফিরে আসছিলো না।
কিছুদিন পর তিনি জানতে পারেন, ওইদিন তার বাবা শহীদ খগেন্দ্রলাল চাকমা মুক্তিযোদ্ধাদের থানা থেকে অস্ত্র দিয়ে দিয়েছিলেন ও রাতে অফিসের বিশেষ মিশনের জন্য তার বাবা’র বাসায় ফিরতে দেরি হয়নি তিনি থানার কয়েকজন অফিসার ও কনস্টেবল নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক’র মুরাদনগর থেকে ১১-১২ কিলোমিটার দূরে একটি ব্রিজ বোমা মেরে ভেঙ্গে দিয়েছিলো, যাতে পাকিস্তানি হানাদার রা সহজে ঢাকা থেকে এদিকে অগ্রসর হতে না পারে।
এই মিশন’র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শহীদ খগেন্দ্রলাল চাকমা। রতন চাকমা আরো জানতে পারেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি তার বাবা কে অন্যান্যদের থেকে বেশি নির্যাতন করেন তৃতীয় দিন মানে মে মাসের ৫ তারিখ শহীদ খগেন্দ্রলাল চাকমা অমানবিক নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে শাহাদাৎ বরণ করেন। মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন স্যার যদি মুখ খুলতেন আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতেন তাহলে ওনাকে এভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হতো না। কিন্তু স্যার একটি শব্দ মুখ থেকে বের করেন নি।
স্যার যদি ওদেরকে সব বলে দিতে আজ আমারা যারা বেঁচে ফিরেছি আমাদের আর ফেরা হতো না (কথাগুলো যখন মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী বলছিলেন তার চোখ দিয়ে সুধু পানি ঝড়ছিলো) । বাবা’র এত কষ্টকর মৃত্যু’র কথা গুলো জানার পরও প্রায় ৩ মাস তাকে কুমিল্লায় পুলিশ লাইনে থাকতে হয়েছিলো। রতন চাকমা বলেন এই ৩ মাস তার জন্য যে কতটা যন্ত্রণাময় ছিলো তিনি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না।
শেষ পর্যন্ত ওসি রতন চাকমা কে চট্টগ্রামে পরিবার’র কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, একজন এএসআই চট্টগ্রাম এ তার বাড়িতে আসছিলো মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী রতন চাকমা কে তার পরিবার’র কাছে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব ওই এএসআই কে দেন এবং তাকে বিদায় দেন। তারা রওনা দেন চট্টগ্রাম এ আসার জন্য রতন চাকমা বলেন মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী উনাকে মুসলমানদের কালিমা মুখস্থ করিয়েছিলেন এদিকে রতন চাকমা জানান ছোট বেলায় চিকিৎসা জনিত কারনে তার খৎনা করানো হয়েছিলো।
কারণ তার যাত্রাপথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কয়েকটি চেকপোস্ট পার হতে হবে মুসলমানদেরকে ওরা ছেড়ে দিতো। যাতে তিনি বিপদে না পড়েন ও নিরাপদে পরিবার’র কাছে ফিরতে পারেন তাই মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী বাধ্য হয়ে উনাকে মুসলমানদের কালিমা মুখস্থ করান। সাথে থাকা এএসআই বার বার রাস্তায় তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন ও কালিমা মুখস্থ আছে কিনা দেখছিলেন। যদিও যাত্রাপথে কোন সমস্যা হয়নি।
বাকি অংশ পড়ুন পরবর্তী পর্বে-