শান্তিচুক্তির পরও কেন রক্তাক্ত পাহাড় ?

594

মনিরুজ্জামান মনির- ৩০ মে ২০১৮, দৈনিক রাঙামাটি:  রাঙামাটিতে আধিপত্যের জেরে তিন ইউপিডিএফ কর্মী নিহত। অল্প দিনের ব্যবধানে আবার ইউপিডিএফ এর তিন কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আবার রক্তাক্ত হলো পাহাড়। গত ছয় মাসে নিহত হয় ২১জন। মে মাসেই খুন করা হয় ১০জনকে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম থেকে সংগৃহীত এই হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তির চিত্র। শান্তিচুক্তির ২০ বছর পরেও কেন রক্তাক্ত প্রকৃতির লীলাভূমি আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল ?

মহান গৌতম বুদ্ধের অমর বানী ছিল- ‘জীব হত্যা মহাপাপ, অহিংসা পরম ধর্ম। আমাদের পার্বত্যবাসী উপজাতি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির স¤প্রদায়ের সিংহভাগই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তাই বৌদ্ধ পূর্নিমা, মাঘী পূর্ণিমা, বিজু উৎসব, সাংগ্রাই, বৈশুক, শেষকৃত্য, কঠিন চীবর দান ইত্যাদি সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অনেক সহজ সরল প্রান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উপজাতীয় নারী-পুরুষ অত্যন্ত ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে এই ধর্মটি পালন করে থাকে। আমাদের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংখু, লুসাই, বম, মুরং, চাক, নেপালী, রাখাইন, গুরখা, অহমিয়া প্রভূতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির বসবাস। এরা বাস্তবেও খুবই সহজ-সরল এবং সনাতন ধর্মেরও অনুসারীও বটে।

কিন্তু বর্তমানে খুন-খারাবী, বন্দুকযুদ্ধ, চাঁদাবাজী, মুক্তিপন, গুম, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, আনারস বাগানে বিষ প্রদান, কচি কচি সেগুন চারা, আম, কাঠাল, বটবৃক্ষ, রাবার বাগান, চা বাগান ধ্বংস করার জন্য অহরহ যারা সশস্ত্র রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা চালাচ্ছে, তারাওতো বৌদ্ধ ধর্মেরই অনুসারী। এরা ছদ্মবেশে অনেক বৌদ্ধ মন্দিরেও ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারের ছাত্রাবাসে বিনা ব্যয়ে থাকা-খাওয়ার সুযোগও পেয়ে আসছে। এরাই যখন নিরাপত্তা বাহিনীর এমবুশে পড়ে তখন তারা বুদ্ধকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। দেশে বিদেশে তারাই অপপ্রচার চালিয়ে বলে বেড়ায়- বাঙালিরা তাদের বৌদ্ধমুর্তি ভেঙ্গে দিচ্ছে, কিংয়াং ঘরে আগুন দিচ্ছে কিংবা লুটপাট নামক শব্দটিও যথেচ্ছ ব্যবহার করে থাকে। অথচ- এই পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা কি আদৌ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ? এরা তো জীব হত্যাকে খুব সহজেই আলিংগন করছে।

এতদিন বাঙালি হত্যা ও বাঙালিদের প্রতি হিংসা করেই তারা নিরব ছিল। কিন্তু এখন স্বজাতির উপরও তাদের শানিত কৃপান ও তরবারি ও আগ্নেয়াস্ত্রটি নিখুত ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এরা যে কোন দল বা সংগঠন করুক না কেন এদের প্রকৃত পরিচয়, এরা ঘাতক, খুনি, চাঁদাবাজ, রাষ্ট্রদ্রোহী এবং বৌদ্ধজাতির কলংক ও কুলাঙ্গার মাত্র।

বাংলাদেশ একটি অসা¤প্রদায়িক ক্ষুদ্র আয়তনের রাষ্ট্র। স্বাধীনতার পর থেকেই পাহাড়ে তথাকথিত শান্তিবাহিনী পৃথক ভাবে ‘স্বাধীন জুমল্যান্ড’ ঘোষণা করে তিন পার্বত্য জেলায় গণহত্যা শুরু করেছিল। এম.এন লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ের সরলপ্রাণ যুব সমাজকে ‘বাঙালি হত্যার’ দীক্ষা দিয়ে গঠন করা হয়েছিল খুনী শান্তি বাহিনী বা জুম্ম লিবারেশন আর্মী। পাহাড়ের উপজাতিদেরকে বানানো হয়েছিল জুম্ম জাতি (বাঙালি বা বাংলাদেশী নয়)। তখনো আদিবাসী বলে পাহাড়ে কোন নব্য স¤প্রদায়ের উত্থান হয়নি। জুন্মজাতির মুখপাত্র ছিল জুম্মকন্ঠ, জুম্ম নিউজ বুলেটিন, রাডার, সেটেলাইট ইত্যাদি। স্বপ্নের জুমল্যান্ড পেতে এম এন লারমা ও সন্তুু লারমারা এ পর্যন্ত পাহাড়ে ৩০ হাজার বাঙালিকে বর্বর হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর মতো নিষ্ঠুরভাবে পশুর মতো হত্যা করেছে। সেই ঘাতক গেরিলা ট্রেনিং আজ ব্যবহৃত হচ্ছে উপজাতিদেরই স্বজনদের বিরুদ্ধে। শান্তিচুক্তি করেও মানুষ হত্যার যে মহান (?) প্রশিক্ষণ তারা পেয়েছিলেন, তা আজও ভুলতে পারছেন না। জিঘাংসা ও মানবহত্যার প্রেতাত্মারা তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে উপজাতি যুবকদেরকে। সেই ঘৃন্য- দু:সাহসিকতা ও মানবহত্যার ধারাবাহিকতার বলি হচ্ছেন- শক্তিমান চাকমা, তপন জোতি চাকমা (বর্মা), স্মৃতি চাকমা, অটল চাকমা, সজীব চাকমাসহ অনেক সম্ভাবনাময় উপজাতি তরুণ ও যুব সমাজ যারা পাহাড়ে আগামীদিনের জাতি গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারতেন। ৩০ হাজার বাঙালি হত্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল ওমেন ফেডারেশনসহ সন্তুু বাবুদের নতুন প্রজন্মের জন্য।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দেশের এক দশমাংশ অঞ্চল রক্ষার জন্য এবং দুই যুগের হিংসা হানাহানি বন্দের জন্য ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ইং স্বাক্ষরিত হয়েছিল ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি। এর শতকরা ৯০ ভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে, পাহাড়ে গঠিত হয়েছে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ যার চেয়ারম্যান হলেন বাবু সন্তুু লারমা এবং সদস্য তারই পছন্দনীয় জেএসএস নেতৃবৃন্দ। এছাড়া তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে যার চেয়ারম্যান এবং মেম্বাররা সিংহভাগই চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির। পাহাড়ে তাদের ইশারা ছাড়া প্রশাসন চলতে পারে না। তাদের কথায় উঠে বসে ডিসি, এসপি, জেলা প্রশাসনসহ সবাই। এমনকি পাহাড়ে কর্মরত খোদ সেনাবাহিনীর ক্ষমতাও আজ শূন্যের কোঠায়। এর পরও সন্তু বাবুরা আর কি ক্ষমতা চান জাতিকে খুলে বলুন। কেন এত রক্ষপাত, কেন এত বন্ধুক যুদ্ধ জাতি জানতে চায়।

আজ পাহাড়ে বাঙালি হত্যা বন্ধ হলেও উপজাতি হত্যা বন্ধ হচ্ছে না কেন? ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আজ অন্ধ হয়ে গেছে উপজাতি নেতৃবৃন্দ, উপজাতি যুব সমাজ ও ক্ষমতাশীন গোষ্ঠি। ‘সন্ত্রাস কোন দিন মুক্তি আনতে পারে না’ এই নীতি বাক্যটি অনেকবার পাহাড়ে যুব সমাজকে জানানোর পরেও আজ তাদের মধ্যে জিগাংসা মনোবৃত্তি কেন ? এ জন্য উপজাতি নেতারাইকি দায়ী নন। এই খুনের জন্য নেশাগ্রস্থ উপজাতি যুব সমাজকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিতে হবে সরকার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ উপজাতি নেতৃবৃন্দকে।

লেখক- মনিরুজ্জামান মনির
মহাসচি- পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন
সাবেক ডেপুটিকমান্ডার- বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাঙামাটি জেলা ইউনিট।
পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরো প্রধান।