‘সব অনভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, আর নিজের অনুভূতি আসলে অনুভবে যে ভাবে থাকে অন্যের কাছে বলে সেটা ফুটিয়ে তোলা সম্ভবও না’। এমন বক্তব্য বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে যোগদান করা প্রাক্তন ছাত্রী ডা: সাইয়্যেদা মোকাদ্দেসার।
তিনি বলেন, অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে ভাবতেই পারিনি এতটা আনন্দময়, এতো বেশী প্রাণোচ্ছল এবং এতো বর্ণাঢ্য আয়োজন হবে। ‘কিশোরী জীবনের উচ্ছল দিনগুলির পাশে যেন নতুন দু’টি দিন যোগ হলো’।
রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানটি যেন ছিল শিক্ষিত নারীদের এক মহা মিলন মেলা। দুর্যোগপূর্ণ বৈরী আবহাওয়ার মাঝেই দুদিনের এই অনবদ্য আয়োজন অবশেষে নিরাপদে শেষ হয়েছে।
যাটোর্ধ মহিয়সী মা, যিনি দাদী হয়ে পুতিনের মুখ দেখেছেন, এমন নারী থেকে শুরু করে একেবারে ষোড়শী কিশোরী। সব বয়সের নারীরা আনন্দে মেতেছিলেন আপন মহিমায়। সবার চোখেমুখে ছিল এক অনাবিল দীপ্তি আর কৈশরে ফিরে যাওয়ার উন্মাদনা। স্মৃতিচারণ আর পুরণো সখীকে কাছে পাবার আনন্দতো ছিলই।
তার সাথে ছিল জীবনের স্মৃতিপটে জ্বলজ্বলে দিনগুলোর উজ্জীবনী শক্তি। কেউ হয়তো পুরনো দিনের কোনো বিষাদমাখা স্মৃতির কথাও মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন; তবে ক্ষণিকের জন্য। বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন পূণর্মিলনীতে। দু’দিনের গসিপ, না বলা কথা, ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন; সব মিলিয়ে আবারও সাথে করে নিয়ে গেলেন নতুন স্মৃতি।
সবার মুখে ছিল আয়োজনের প্রশংসা আর আনন্দের ফুলঝুড়ি। এই অনুষ্ঠান তাই ইতিহাসের অংশ হলো। একদিন একে ঐতিহাসিক দিন বলার সময় এই মহিয়সিদের ক’জন থাকবেন তা বিধাতাই ভালো জানেন।
তবে সফল নারী, শিক্ষিত নারী, শিক্ষিকা নারী, ডাক্তার, উকিল, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নানা পেশার এই শিক্ষিত নারীরা আমাদের জাতীয় সম্পদ। শিক্ষিত নাগরিক তৈরির সূতিকালয় এবং আগামী প্রজন্মের প্রেরণা।
এতো ইনিয়ে বিনিয়ে এই অনুষ্ঠানটির বর্ণনা দেওয়ার পিছনে আমার উদ্দেশ্য একটাই। বাংলাদেশের নারী শিক্ষা এবং আগামী দিনের জাতি গঠনে এ ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে কতটা প্রয়োজন তাই আর একবার বোদ্ধাদের সামনে এবং নেতাদের দেমাগে উস্কে দেওয়ার জন্য। বিশেষ করে যখন পার্বত্যাঞ্চলের মতো পিছিয়ে পড়া এলাকায় নানা বাধা বিপত্তির প্রতিকূলে গড়ে ওঠা একটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৫০ বছরের গৌরবোজ্জল দিন পার করে।
গত জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫ সালের হিসাব জরিপ অনুযায়ী জানান, আমাদের দেশে বর্তমানে (জরিপ সময়ে) মোট শিক্ষার হার ৬১ শতাংশ।
আর শিক্ষামন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানানো হয়েছে, আমাদের দেশে ১৫ ও এর উর্ধ্ববয়সী নারীর স্বাক্ষরতার হার বর্তমানে ৪০.৮ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক ও তৎপরবর্তী শিক্ষায় নারীর ভর্তি হার মাত্র ৪ শতাংশ। কারণ বাল্যবিবাহের কারণে শতকরা ৪১ ভাগ কিশোরীকে স্কুল ত্যাগ করতে হয়।
এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আমরা নারী শিক্ষায় এখনও পিছিয়ে রয়েছি। তবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে ভর্তির হার শতকরা ৯১ ভাগ যার মধ্যে মেয়ে শিশুরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে (যথাক্রমে ৯৪.৭ শতাংশ ও ৮৭.৮ শতাংশ)।
বিশ্বে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হিসাব করা হয়ে থাকে। এই হিসাবে ‘বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৪৫টি দেশে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে করা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। এ ছাড়া বাংলাদেশের ৬৪ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর বয়স হবার আগেই।
১৫ থেকে ১৯ বছরেই অন্তসত্ত্বা কিংবা মা হয়ে যান এক তৃতীয়াংশ নারী। সারাবিশ্বে প্রতি মিনিটে ৩৮০ জন নারী গর্ভবতী হয়, ১৮০ জন নারী অপরিকল্পিত বা অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ করে, ১১০ জন নারী গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগে, ৪০ জন নারী অনিরাপদ গর্ভপাত ঘটায় এবং প্রতি মিনিটে ১ জন নারী মারা যায়।
এমন প্রেক্ষাপটে আমরা নারীদের শিক্ষা কর্মে, নেতৃত্বে এবং উন্নয়নে সেভাবে এগিয়ে নিতে না পারলে যে আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ অথবা এসএমডিজি পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের অর্জনও নেহায়েত কম নয়, ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে মাত্র পাঁচজন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বর্তমানে সংসদে ৬৯ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। এছাড়া মন্ত্রীভায় বর্তমানেও একাধিক নারী আছেন, আগে আরো বেশী ছিল; আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, এমনকি জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী।
তবে নারীর সমতা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি যে চারটি মাপকাঠিতে বিবচেনা করা হয়, তাতে বাংলাদেশ কেমন অবস্থান, সেটাই দেখার বিষয়। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অর্জন, স্বাস্থ্য এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিবেচনা করে এ সূচক প্রকাশ করা হয়৷ সে ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন সন্তোষজনক নয় বা বিশ্বে অবস্থান ৬৪তম অবস্থানে।
এর পরও আশার কথা হলো বাংলাদেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩৪টি। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩ হাজার ১৩৩, অর্থাৎ শতকরা ৭.৬ ভাগ। উপসচিব পদ থেকে সচিব পদ পর্যন্ত নারীদের সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ বা তারও কম।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিচার বিভাগে বিচারক পদের ১০ শতাংশ হলো নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ ভাগ কর্মীই নারী। আর দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবহারকারীও নারী।
নারীর সমতার বিষয়টি দেখা হঢ ৫০-৫০ হিসেবেঅ এরসঙ্গে নারীর মানবাধিকার, ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নারী উন্নয়ন মডেল অনুযায়ী, সমতা এবং ক্ষমতায়নের জন্য চারটি বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রথমত: ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নারীর মালিকানা স্থাপন, দ্বিতীয়ত: মানসম্মত কাজের পরিবেশ ও মজুরি।
তৃতীয়ত: শান্তি ও ন্যায়বিচার বা নায্যতা। এবং চতুর্থত: সকল স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর যা কিছুই আমরা করতে চাই, তার জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। সেই পথে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৫০ বছর গৌরবের সাতে পার করেছে। ফেলে আসা সাথীদের মিলন মেলা যেন অনুপ্রেরণার এক বহতা নদী। শিক্ষিত নারীদের এই মহামিলন তাই অনবদ্য অতুলনীয়।