৭১’রে সম্মুখ সমরে বঙ্গরত্ন ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন

722

বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ১৯৭১ এবং শ্রেষ্ঠ কাজ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ। বঙ্গরত্ন  ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন তাদেরই একজ। ইতিহাস মতে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ১১টি সেক্টরে বিভক্ত ছিলেন। এর বাইরেও মুক্তিযোদ্ধারা আরো দশটি বাহিনীতে বিভক্ত ছিলেন। তার একটি বাহিনীর নাম- আবুল হোসেন বাহিনী “ফোর্সেস অব ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন”। তিনি ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই বীর সন্তানকে জাতির কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হল।

শামীমুল আহসান- ঢাকা ব্যুরো প্রধান, ৫ আগস্ট ২০১৮, দৈনিক রাঙামাটি:  মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক সংগঠক, গবেষক ও সমাজসেবক, ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন। স্বনামখ্যাত ও জনপ্রিয় একটি মুখ। বঙ্গরত্ন  ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন নামেও তিনি সুপরিচিত। টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার সেহড়াতৈল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা মৌলভী খোরশেদ আলী ছিলেন বরেণ্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবক। মাতার নাম রাবেয়া খাতুন।। দাদা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রিয়াজ উদ্দিন সরকার ছিলেন এলাকার বিশিষ্ট জন ও সমাজ সেবক। তাঁর পরিবার পরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার খরশিলা গ্রামে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক (৫০) (বি.এ) জনতা ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। বাবা মৌলভী খোরশেদ আলী (৭৭) ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট ও মা রাবেয়া খাতুন (৮৯) ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। তার নানা প্রয়াত কাজী এখলাস উদ্দিন ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ডেভিড হেয়ার হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর (নাগরপুর … ?) এলাকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন।

সমাজ সচেতন মেধাবী আবুল হোসেন সিরাজগঞ্জ জেলার বোয়ালকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। পরে আনুহলা জুনিয়র হাইস্কুল এবং ছিলিমপুর এম এ করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তিনি শৈশব থেকেই সংগঠন প্রিয় ছিলেন। হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন। এখানেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। সক্রীয় ছিলেন গণঅভ্যুত্থান পরবর্তি আন্দোলন-সংগ্রম ও মুক্তিযুদ্ধে।

পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারসহ ঢাকার রাজারবাগের পুলিশ হেডকোয়ার্টার, পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলসহ অন্যান্য হল, নবাবপুর ও শাখারীপট্টি এলাকায় পাকবাহিনীর নৃশংস আক্রমণে ৫০ হাজারের অধিক মানুষকে এবং চট্টগ্রামের ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে নিরস্ত্র ১ হাজার বাঙালী সেনাকে হত্যা করার খবর পেয়ে ২৬ মার্চ বিকেল ৪.৩০ মি. টাঙ্গাইলের খরশিলা ঈদগাহ খেলার মাঠে প্রায় দুই থেকে তিন হাজার লোকের সমাবেশে করে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানকে পাক-হানাদার বাহিনীমুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে টাঙ্গাইলের চর অঞ্চলের ১৭৫ যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নদীপথে ভারতে যান। ভারতের মেঘালয়ের তুরার রওশন আরা ক্যাম্পে ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজীর তত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে তিনি জুন মাসে নদীপথে বাংলাদেশে এসে তাঁর এলাকার পরিচিত আরও ৬২ জনকে ভারতে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেন। এসময় মুক্তিযোদ্ধারে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৭ জনে। সর্বশেষ আগস্ট মাসে এসে তাঁর এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের আহ্বান জানালে ক্রমান্বয়ে এর সংখ্যা বেড়ে ১২৫০ এ পৌঁছায়। প্রশিক্ষণ শেষে আবুল হোসেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১১ নং সেক্টর এলাকায় ভারতীয় এফ, জে, সেক্টরের অধীনে ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন।

 


যুদ্ধকালীন গোয়েন্দা নজরদরীর দায়িত্ব থাকার সুবাদে তিনি ভারতীয় এফ,জে সেক্টর গোয়েন্দা সংস্থার ক্যাপ্টেন গোল্ড ব্লাডার, ৬ বিহার রেজিমেন্টের মেজর চৌহান, ৪৩ বিএসএফ এর লে. কর্ণেল রঙ্গরাজ ও ১৩ গার্ড রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বি.কে  পানওয়ার, ৬৬ মাউন্টেন (আর্টিলারী) রেজিমেন্ট কমান্ডার লে. কর্ণেল কে.এস ব্রার, ভারতীয় এফ,জে সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজী ও ৯৫ মাউনটেইন ব্রিগেড গ্রæপের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লার (হরদেব সিং ক্লার) ও ১৬৭ ব্রিগেড গ্রæপ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইরানী প্রমুখের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়। যুদ্ধকালীন গোয়েন্দা কর্মকান্ডের কোন এক পর্যায়ে সানসিং বাবাজীর মাধ্যমে ভারতের নাগাল্যান্ডের ৯৫ মাউনটেইন ব্রিগেড, ছত্রীসেনা (জঙ্গী ব্যাটালিয়ন), ৬ বিহার রেজিমেন্ট, ৪৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন ও এফএফ ট্রুপস এর সমন্বয়ে গঠিত ১০১ কমিউনিকেশন জোনের (ডিভিশনের) জিওসি মে.জে. গুরবাক্স সিং এবং পরবর্তীতে গুরবাক্স সিং মাইন বøাস্টে আহত হলে তার স্থলে দায়িত্বপ্রাপ্ত জিওসি মে.জে গান্ধব সি নাগরার সাথে পরিচয় ঘটে এবং সখ্য গড়ে উঠে। এতে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পুরো সীমান্ত এলাকায় তাঁর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান।

মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন (আবু) ৪ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে ময়মনসিংহ ও জামালপুর আক্রমণের পূর্বেই শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলের ১১ নং সেক্টর এলাকার ভারতীয় এফ, জে সেক্টরের অধীনে অনেকগুলো সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে তিনি ১৭-১৮টি সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এ সকল যুদ্ধের মধ্যে কয়েকটি ছিল ভয়াবহ যুদ্ধ। বক্সীগঞ্জের কামালপুর, শ্রীবর্দীর ভায়াডাঙ্গার নকসি ও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট যুদ্ধ ছিল ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের নেতৃত্বাধীন ভয়াবহ ও স্মরণীয় যুদ্ধ। “ফোর্সেস অব ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন” শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও নেত্রকোনা অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় ‘আবুল হোসেন বাহিনী’ নামে পরিচিত।

যুদ্ধ কালীন সময় মুক্তিযুদ্ধে প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরিচয়ের ঘনিষ্টতায় একটু ফুরসত পেলেই জেনারেল ওসমানী তাঁর সাথে খোশগল্প করতেন। তাঁর সহযোগী নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মো: শাহজাহান মিয়া, দেলবর আনসারী, বেলাল হোসেন (আলী), আব্দুস সামাদ মাস্টার, রফিকুল ইসলাম, আবু সাঈদ, আব্দুল মান্নান, কোরবান আলী, ময়েজ বিএসসি, আব্দুল জলিল, আব্দুল কাদের, মোকাদ্দেস আল মামুন (এস. এম. মোকাদ্দেছ আলী), ছানোয়ার হোসেন-১, মোহাম্মদ সেলিম, ইমান আলী ও আবু হাছান মাস্টার (হাছেন আলী) প্রমূখ অন্যতম। অন্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আমিনুল ইসলাম, জহুরুল হক মুন্সী বীর প্রতীক বার, শহীদ শাহ্ মোতাচ্ছিন বিল্লাহ্ খুরম, ছানোয়ার হোসেন-২, মনোরঞ্জন সাহা, মাহমুদ আলী ও দিলীপ কুমার সাহা।

ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন (আবু) কামালপুরের যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। জামালপুর জেলার বক্সীগঞ্জের কামালপুরে সংঘটিত কয়েকটি যুদ্ধ ছিল সারা দেশের সকল যুদ্ধগুলোর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ। এখানে একেকটি যুদ্ধ বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকদিনব্যাপী চলে। ৩১ জুলাই কামালপুর পাকিস্তানী আউটপোস্ট আক্রমণ করা হলে মেজর আইয়ুবের নেতৃত্বে পাকিস্তান ৩১ বেলুচ ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মেজর সালাউদ্দিনসহ ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৩ জন শহীদ হন এবং লে. মান্নানসহ ৬৬ জন আহত হন। যুদ্ধকালীন ৩১ বেলুচ ব্যাটালিয়নের সেনাসদস্যরা ভারত অভিমুখে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ব্রহ্মপুত্র সংযোগ নদীতে কুমারঘাট এলাকায় পাহাড়ী ঢলে পানিতে ঢুবে বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা মারা যায়।

২২ অক্টোবর ভারতীয় সেনাসদস্যদের সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর কামালপুর আউটপোস্টে যুদ্ধকালীন রাস্তায় একটি এন্টিট্যাংক মাইন বসানোর সময় বিস্ফোরণে ভারতীয় ১৩ গার্ড রেজিমেন্টের মেজর রতন সিং মারা যান। আহত হন ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। ২ নভেম্বর, ১৯৭১ রাতে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা শ্রীবর্দীর ভায়াডাঙ্গার নকসি পাকিস্তান সেনা ক্যাম্প আক্রমণ করলে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে আবু তাহের, আব্দুল গনি ও আরও ১জন শহীদ হন।

১৪ নভেম্বর ভারতীয় ১৩ গার্ড রেজিমেন্টের সহযোগিতায় ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা জামালপুরের কামালপুর চেকপোস্ট আক্রমণ করেন। মুক্তিবাহিনী বক্সীগঞ্জ-কামালপুর রোডে ব্যারিকেড তৈরি করেন। পাক মর্টারস্ গ্ুপ কামালপুরের পাকসেনাদের সহায়তার জন্য ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের নেতৃত্বে বক্সীগঞ্জ থেকে কামালপুরের সন্নিকটে পৌঁছানোর সাথে সাথে রাস্তার দু’পাশ থেকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই ১০ জন পাকসেনা মারা যায় এবং আহত হয় ৭ জন। এ যুদ্ধ চলাকালীন মেজর আবু তাহেরের একটি পা ২ ইঞ্চি মর্টার সেল এর আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজীর সাথে যোগাযোগ করে তাঁর মাধ্যমে দ্রæত চিকিৎসার জন্য মেজর আবু তাহেরকে হেলিকপ্টারে করে ভারতের গৌহাটি কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে পাঠান। মেজর তাহেরের সঙ্গে ছিলেন তাঁর বড় ভাই মো. ইউসুফ।

নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর চেকপোস্ট বক্সীগঞ্জের সাথে বিচ্ছিন্ন করে ফেলায় ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল সুলতান মাহমুদ খানের নির্দেশে ২৭ নভেম্বর ৩ কলাম সেনাসদস্য কামালপুর আউটপোস্টের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর ভারী আর্টীলারীর আঘাতে বক্সীগঞ্জে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। ৪ ডিসেম্বর সর্বশেষ পাক-মেজর আইয়ুব কামালপুর চেকপোস্টের সেনাসদস্যদের সাথে মূল কমান্ডের সংযোগ করার জন্য শ্রীবর্দী থেকে বক্সীগঞ্জ হয়ে কামালপুর চেকপোস্টের দিকে একদল সেনাসদস্য নিয়ে অগ্রসর হলে পথিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কিছু সংখ্যক সেনাসদস্যসহ নিজে প্রাণ হারান। একই রাতে যৌথ বাহিনী কামালপুর চেকপোস্ট আক্রমণ করেন। এতে পাকসেনাদের যেমন জীবনহানি ঘটে তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন শহীদ হন। অবশেষে কোন উপয়ান্তর না দেখে কামালপুর চেকপোস্টের ক্যাপ্টেন আহসান মালিক তাঁর সেনাসদস্যদের নিয়ে যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন।

যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৫-৬ ডিসেম্বর, আবুল হোসেন তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে হালুয়াঘাট আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধকালীন তাঁর সহযোদ্ধা আব্দুল বাছেত বাশার শহীদ হন এবং ১১ জন ভারতীয় সৈন্য মারা যান। হালুয়াঘাট মুক্ত করার পর ৮ ডিসেম্বর আবুল হোসেন তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে যৌথ বাহিনীর সাথে ময়মনসিংহের ফুলপুর আক্রমণ করেন। ফুলপুর মুক্ত করার পর ৯/১০ তারা যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর ময়মনসিংহ সেক্টর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেন। ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ পাকহানাদার মুক্ত হয়। এ যুদ্ধে কয়েকজন অফিসারসহ বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনার প্রাণহানি ঘটে। কিছু সংখ্যক ভারতীয় সেনাসদস্য মারা যান এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। ১ জন কর্ণেল ও কয়েকজন অফিসারসহ ৫৫১ জন পাকসেনা যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। ময়মনসিংহ যুদ্ধে আবুল হোসেন ও তার সহযোদ্ধাদের বীরগাঁথা ও সাহসীকতার কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রশংসনীয় ভাবে উল্লেখ রয়েছে।

যৌথবাহিনী ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর জামালপুর সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন ৯ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর ৯৫ মাউন্টেইন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লার এর নির্দেশে পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান সম্বলিত পত্র দিয়ে তার সহযোদ্ধা মো. জহুরুল হক মুন্সীকে জামালপুরে পাকবাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্ণেল সুলতান মাহমুদ খানের কাছে দূত হিসেবে পাঠানো হলে সেখানে তাকে অমানসিক নির্যাতন করা হয়। পাক অধিনায়ক অস্ত্রের জবাব অস্ত্র দিয়ে দেয়া হবে লিখে একটি তাজা বুলেট ঐ লিখিত কাগজে মুড়িয়ে ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লারকে দেয়ার জন্য জহুরুল হক মুন্সীকে ফেরত পাঠান। তিনি কোনক্রমে যৌথ বাহিনীর শ্রীবর্দী ক্যাম্পে চলে আসেন। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন বিশেষ রেডিও বার্তায় জহুরুল হক মুন্সী আহত হওয়ার খবর পান। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর অনুরোধে যৌথ বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লার তাঁকে হেলিকপ্টার যোগে চিকিৎসার জন্য ভারতের পুনায় পাঠান। ১১ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর হাতে জামালপুরের পতন ঘটে। এখানে ৮১০ জন পাকসেনা যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।


১০ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনীর ৯৩ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাদির খান ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল সুলতান মাহমুদকে জামালপুর থেকে ১টি ট্রুপস নিয়ে মধুপুর জাংশনে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেয়। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর নেতৃত্বে ময়মনসিংহ থেকে আগত মুক্তিবাহিনীর ১টি ইনফ্যানট্রি ইউনিট ও অন্য একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে পশ্চিম জামালপুর থেকে আগত মুক্তিবাহিনীর আরও একটি ইনফ্যানট্রি ইউনিট অর্থাৎ যৌথবাহিনীর নিয়ন্ত্রনাধীন ডিফেন্সে থাকা মুক্তিবাহিনীর ২টি ইনফ্যানট্রি ইউনিটের সাথে লে. কর্ণেল সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বের ২ কোম্পানী পাকসেনাদের মধুপুরের অনতিদূরে জামালপুর-মধুপুর রোডে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩০ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ২৫ জন। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন শহীদ হন এবং কিছুসংখ্যক আহত হন। যুদ্ধের অগ্রভাগে থাকা লে. কর্ণেল সুলতান মাহমুদ অলৌকিকভাবে অক্ষত অবস্থায় টাঙ্গাইলের অস্থায়ী ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে চলে আসেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় এনে পাক ৩৩ পাঞ্জাব ইনফ্যানট্রি রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের ২ কোম্পানী ও মর্টারস ইউনিট মধুপুর জাংশন ছেড়ে কালিহাতির পুংলী ব্রিজের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নেয়।

এ অবস্থায় ১১ ডিসেম্বর ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন ও তার সহযোদ্ধারা যৌথবাহিনীর নেতৃত্বে মধুপুর হয়ে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হন। এদিকে কালিহাতিতে ভারতীয় ২ প্যারাসুট ব্যাটালিয়নের সাথে যোগ দেয় ময়মনসিংহ ও জামালপুর থেকে আসা যৌথবাহিনী। এসময় কাদেরিয়া বাহিনী প্যারাসুট ব্যাটালিয়নের নিরাপত্তা ও গাইড দেন। কালিহাতির পুংলী ব্রিজের পাক ডিফেন্সের সাথে যৌথবাহিনীর যুদ্ধ হলে পাকবাহিনীর কিছু সংখ্যক সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। তাঁরা পিছু হটে টাঙ্গাইলের সার্কিট হাউজ এলাকায় অবস্থান নেয়। টাঙ্গাইল মুক্ত হওয়ার পর যৌথবাহিনী ১২ ডিসেম্বর মির্জাপুর ও ১৩ ডিসেম্বর কালিয়াকৈর হয়ে মৌচাক পৌঁছেন। কাদেরিয়া বাহিনী যৌথবাহিনীর অগ্রযাত্রায় লজিস্টিক সাপোর্ট ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন। ১৩ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর জিওসি মে.জে. নাগরার নির্দেশে ২ প্যারাসুট ব্যাটালিয়ন ও ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর তত্ত¡াবধানে মুক্তিবাহিনীর ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের ১টি ইউনিট কালিয়াকৈর-সাভার লিংক রোড দিয়ে সাভার পৌঁছেন। ১৪ ডিসেম্বর মৌচাক-জয়দেবপুর ও টঙ্গী লিংক রোডের সন্নিকটে যৌথ বাহিনী (ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর নেতৃত্বের মুক্তিবাহিনীর ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের ২টি ইউনিটসহ) ও পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩টি ট্যাংকসহ অনেকগুলো সাজোয়া যান ধ্বংস হয়, যৌথ বাহিনীরও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময় জয়দেবপুর ও টঙ্গীর  যোদ্ধারা তথ্য ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে যৌথবাহিনীকে সর্বাত্বক সহযোগিতা করেন। পাকবাহিনী টঙ্গী ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থান নেয়। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন ও তার সহযোদ্ধারা যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে টঙ্গী ব্রিজের উত্তর পার্শ্বে অবস্থান নেন। ইতোমধ্যে মে.জে. নাগরার নির্দেশে ২ প্যারাসুটসহ যৌথবাহিনীর ৩ গার্ড রেজিমেন্টের কিছুসংখ্যক সদস্য ও ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন এর তত্ত¡াবধানে মুক্তিবাহিনীর ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের ১টি ইউনিট ১৬ ডিসেম্বর ভোরে মিরপুর ব্রিজে পৌঁছেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন ও তার সহযোদ্ধারা ঢাকায় প্রবেশ করেন।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেল ৪.৩১ মিনিটে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে.জে.এ.এ.কে নিয়াজীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার নিকট পাকবাহিনী ৯৩ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করলে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ময়মনসিংহ বেস ক্যাম্পে ফিরে আসেন। সম্মুখ সমরে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজী আবুল হোসেনকে সাময়িকভাবে ময়মনসিংহের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেন। তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনও করেন।
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হোসেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরলে উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নিকট অস্ত্র সমর্পন করে আবুল হোসেন তার সহযোদ্ধাদের বিদায় সম্ভাষণ দিয়ে ২৭ জানুয়ারী ১৯৭২ গ্রামের বাড়ী টাঙ্গাইল সদর থানার খরশিলা গ্রামে চলে আসেন।

[তথ্য সূত্র: গ্রন্থ- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: ১৫ ভলিউম, ঢাকা; মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। প্রকাশ কাল- ২০০৪। গ্রন্থ- “১৯৭১” বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণা ও রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মে. জে. মোঃ সারোয়ার হোসেন সম্পাদিত। প্রকাশ কাল- ১১ জানুয়ারী, ২০১৮।

যুদ্ধ শেষে আবুল হোসেন পুনরায় লেখাপড়ায় মননিবেশ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণিতসহ ৩টি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর বাগবাড়ী চৌবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এক বছর বিজ্ঞান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট) থেকে ১৯৭৫-৭৬ শিক্ষাবর্ষে ইঞ্জিনিয়ারিং (বিএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সকল বিষয়ে (২১টি) লেটার মার্কসসহ এমবিএ পাস করেন।

[ স্বাধীন বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেনের বর্নাঢ্য রাজনৈতিক ও কর্মময় জীবন বিস্তর পরবর্তিতে অন্য কোনো প্রতিবেদনে প্রকাশ করার প্রতিশ্রæতি রইলো ]