অর্ধ শতাব্দীতে শিক্ষক সঙ্কট কাটেনি রাজস্থলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের

103

॥ আজগর আলী খান ॥

নামে সরকারি স্কুল, কিন্তু ফলাফলে হতাশাব্যঞ্জক, এমন একটি সরকারি বিদ্যলয় হলো রাজস্থলী উপজেলার তাইতং পাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। শিক্ষক সঙ্কট, ভবন সঙ্কট এবং পরিচালনায় নানা অনিয়ম নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এ বিদ্যালয়টি। উপজেলার একমাত্র সরকারি এই উচ্চ বিদ্যালয়টিতে নানা সঙ্কটের পাশাপাশি দারুন শিক্ষক সঙ্কটের কারণে চরম হতাশা প্রকাশ করেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সাড়ে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।

১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির বয়স অর্ধশতাব্দীর বেশি হলেও সরকারি করণের পরও পেরিয়ে গেছে তিন যুগ। ১৯৮৭ সালে বিদ্যালয়টি সরকারি করণ করা হয়। সেই সময়ে যে কয়জন শিক্ষক ছিল তারা অবসরে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় শিক্ষক সঙ্কট। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী যেখানে নতুন পত সৃষ্টি জরুরী সেখানে বিদ্যমান পদগুলিতেও লোক নেই। ১১টি পদের বিপরীতে মাত্র ৩ শিক্ষকের পোস্টিং রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের অনিশ্চয়তা কাটাতে এক সময় এলাকার অভিভাবকেরা নিজেদের পকেটের টাকায় খন্ডকালীন অতিথি শিক্ষক রাখার বিষয়ে একমত পোষণ করে। কিন্তু খন্ডকালীন শিক্ষকদের বিষয়েও তাদের এখন নানা অভিযোগ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয়টিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রেণি কক্ষ না থাকায় শিক্ষার্থীরা গাঁদাগাদি করে পাঠ গ্রহণ করছে। অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও আমরা প্রতিমাসে বাড়তি শিক্ষকের জন্য টাকা দিচ্ছি। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত উজ্জল করতে এ ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায় নেই। কারণ উপজেলায় এটিই একমাত্র সরকারি স্কুল। বিকল্প হিসেবে আর কোনো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এখানেই প্রতি বছর উপজেলার সকল প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিকে ভর্তি হতে ছুটে আসে।

অভিভাবকদের অভিযোগ, সরকারি অতিথি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া নিয়ম বহির্ভূত হলেও আমরা শিক্ষকের জন্য টাকা দেই। কিন্তু ওই শিক্ষকরাও প্রয়োজনীয় আউটপুট দিতে পারছে না। বিদ্যালয় থেকে আমাদের টাকার কোনো হিসাবও আমরা পাইনা। শিক্ষক ফি ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আমাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়া হয়, কিন্তু সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তায় আমরা কিছু বলতেও পারি না। যে বলে তার সন্তানকে বাঁকা চোখে দেখা হয়।
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, দূর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসে। কিন্তু শিক্ষক সংকটের কারণে অনেক বিষয়ের উপর আমরা কোনো ক্লাস পাইনা। বিষয়ভিত্তি শিক্ষক নেই আবার শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। বিদ্যালয়ের অষ্টম ও দশম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী মেহেরুন আকলিমার সাথে কথা বলতে গেলে তারা প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও পরে জানায়, অনেক বিষয়ে একজনও শিক্ষক নেই। এই কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমরা বিপদে পড়েছি, ফলাফল তো এ জন্যই খারাপ হয়। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সানুমা মার্মা বলেন, নামেই সরকারি স্কুল কিন্তু বিষয়ক ভিত্তিক কোনো শিক্ষক নেই, ফলাফলের দায় কে নিবে জানি না, কিন্তু আমাদের জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারি শিক্ষক আসলাম হোসেন স্বীকার করেন যে, শিক্ষক সংকটের কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, ক্লাসে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ার কারণে তাদের প্রয়োজনীয় নার্সিং করা যাচ্ছে না।
এদিকে সরকারের নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ক্লাস নিতে হলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, কিন্তু অতিথি শিক্ষকরা কি সেই প্রশিক্ষণ নিতে পারবে? এমন অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে অভিভাবকদের মাঝে। তাদের সন্তানদের মূল্যায়ন কিভাবে হবে এই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয় গর্ভঃ বর্ডির সভাপতি ও রাজস্থলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শান্তনু কুমার দাশ বলেন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্টানে পাবলিক শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালানো সঠিক নয়। আমি জানতে পেরেছি নিজ সন্তানদের স্বার্থেই এলাকার ভিত্তবানদের অর্থায়নে অতিথি শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

রাজস্থলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওযামী লীগের সভাপতি উবাচ মারমা বলেন, আশির দশকে পশ্চাৎপদ জনপদে অনেকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিদ্যালয়টি সরকারি করণের আওতায় আনাতে পেরেছিলাম, কিন্তু তিন যুগেও শিক্ষক শূণ্যতা কাটেনি। শূণ্যপদে শিক্ষক পদায়ণ যেমন জরুরী তেমনি নতুন পদ সৃষ্টিও দরকার তিনি এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তরিৎ কান্তি বড়ুয়া স্বীকার করেন যে, শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি জানান, আমরা শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অনেকবার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি আমি নিজেও যোগাযোগ করেছি। ভবন সঙ্কটের বিষয়েও চেষ্টা করেছি, বাকিটা আমাদের হাতে নেই।

উপজেলার একমাত্র সরকারি এই বিদ্যালয়টির শিক্ষক ও ভবন সঙ্কট গুছিয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ভবিষ্যত আলোকিত করতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এলাকার সচেতন মহল, শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা।