॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥
আজ ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনেই সেই সময়ের মেহেরপুর মহুকুমার বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেয়। মুজিবনগর সরকার মূলত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয়। সে সময়ই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর।
মুজিবনগর সরকারের কর্মকান্ড বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিল বলে এ সরকার ‘প্রবাসী মুজিবনগর সরকার’ হিসেবেও খ্যাত। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল মুজিবনগর সরকারের কার্যকাল। যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দফতর স্থাপন করেছিল, তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলো মুজিবনগর সরকার রূপে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতাতে স্থাপন করা হয়, প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বার্থে।
১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, আব্দুল মান্নান এম এন এ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম এন এ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। এ ছাড়া পররাষ্ট্র আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, অর্থ শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রী ছিলেন এ এইচ এম কামরুজ্জামান, আর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। মুজিবনগরে ১২ জন আনসার সদস্য বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
১৭ এপ্রিল নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার যেমন সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করেছিল, একইভাবে সরকার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের সচিবালয় ও বিভিন্ন বিভাগ গঠন করেছিল। মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হলেও কার্যত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মূল চালিকা শক্তি।
মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রাক্কালে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়, সেই ঘোষণাপত্রটিই বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক দলিল। বাংলাদেশ দখলদারমুক্ত হওয়ার পর অত্যন্ত অল্প সময়ের ভেতর বঙ্গবন্ধুর সরকার এক অসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, যার ভিত্তি ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সেই ঘোষণাপত্র। আমাদের জন্য এই সরকার গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যুদ্ধের উপরে এর প্রভাব ছিল সুদুর প্রসারী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই এটা ছিল বৈধ সরকার। ফলে বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে যে কোনো ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আইনানুগ ক্ষমতাও ছিল তাদের।
মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুƒদ্ধতা যুদ্ধের রূপ নেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ তারিখেই শুরু হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সংগঠন ও সমন্বয়ে, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে এবং সর্বোপরি এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী দেশ ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনী সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলী পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, এই সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন কাঠামো কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল।
মুজিব নগর সরকার গঠনের সময় যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়, তার ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে বলা হয়‘‘….বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।” নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারে বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য; সেইহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা, পূর্বাহ্ণে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।”
‘এতদ্বারা আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্টপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন-প্রণয়ণের ক্ষমতার অধিকারী। ….”
নবজাত রাষ্ট্রের এই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ ও দেশি-বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
স্মরণযোগ্য যে, ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট সংঘটিত হবার সময় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষ হতে গ্রেফতার করা হয় তার আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ইপিআর এর একটি ছোট ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। এরপর ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিক ভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূলত সেই দিন হতেই বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে পরিচিতি লাভ করে। তবে ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার গঠিত না হলে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন অন্যভাবে বিলীন হয়ে যেতে পারতো।
ঐতিহাসিক এই দিবস ঘিরে রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সকাল ১০টায় জেলাপ্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে ‘ঐতিহাসিক মুজিব নগর দিবস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভা, সন্ধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আধাসরকারি ও বেসরকারি ভবন সমূহ আলোক সজ্জা করা হবে। এছাড়া দিবসটি ঘিরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা ও ধমীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ মোনাজাত/প্রার্থনার ব্যবস্থা রয়েছে।