॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥
আজ সেই বিভিষিকাময় দিন; পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস। ২৫ বছর আগের এই দিনটিতে পাহাড়ে সংঘটিত হয়েছিল এক নির্মম হত্যাকান্ড। একই সাথে ৩৫জন খেটে খাওয়া দিন মজুর কাঠুরিয়াকে হত্যা করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। তৎকালীন শান্তিবাহিনীর এই হত্যাকান্ড পাহাড়ের মানুষকে যেমন হতচকিত করেছিল তেমনি অবাক হয়েছিল বিশ্ববিবেক। কিন্তু দীর্ঘ ২৫ বছরেও বিচার হয়নি রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলাধীন পাকুয়াখালীর সেই ৩৫কাঠুরিয়া হত্যাকান্ডের। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এই শোকাবহ কালোদিনটি মানুষ এখনও স্মরণ করে হতাশায়, ঘৃনায় এবং লজ্জায়। বর্বর এ হত্যাকান্ডের কোন বিচার না পেয়ে হতাশা নিয়েই ধুকে ধুকে দিন কাটাচ্ছে নিহতদের পরিবার। ১৯৯৬ সালে ৯ সেপ্টেম্বর এদিনে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের প্রাক্কালে রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার পাকুয়াখালীর গহীন অরণ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদি সশস্ত্র উপজাতীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ তৎকালীন শান্তিবাহিনী নির্মমভাবে ৩৫ নিরীহ বাঙালী কাঠুরিয়াকে হত্যা করে। সেদিন থেকে পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালিরা এ দিনটিকে ‘পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু গণহত্যার মধ্যে অন্যতম ঘটনা।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ শান্তিবাহিনী লংগদুর ৩৫ জন কাঠুরিয়াকে ব্যবসায়িক হিসাবের কথা বলে পাকুয়াখালী নামক গহীন অরণ্যে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন কাঠুরিয়াদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় ৩৫ জন কাঠুরিয়াকে। এর মধ্যে ইউনুছ নামের একজন কাঠুরিয়া পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরে ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ ও সেনাবাহিনী পাকুয়াখালী হতে ২৮ জন কাঠুরিয়ার ক্ষত বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। বাকি ৭ জন কাঠুরিয়ার লাশ পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর এই দিনে স্থানীয় বাঙালিরা রাঙামাটির পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে থাকে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো অভিযোগ করে বলেন, ৩৫ কাঠুরিয়া হত্যাকান্ডের ঘটনার পর পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি সংসদীয় টিম লংগদু সফর করে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে আসে। এর পরবর্তী সরকারগুলোও একই আশ্বাস দিয়ে আসলেও এখনো এ ঘটনার মামলার কোন কূল কিনারা হয়নি এবং পুনর্বাসিত হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। সেই সময়ে এই হত্যার জন্য সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তি বাহিনীকে দায়ী করা হয়। এরপর প্রায় ২৩ বছর অতিবাহিত হলেও খুনিদের বিচার হয়নি আজও।
এদিকে, হত্যার ঘটনায় বাঘাইছড়ি থানায় মামলা হলেও পরে সিআইডিকে এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই তদন্ত ২২ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। নিহতদের পরিবারের দাবি— সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও পরে কেউ আর তাদের কোনও খবর রাখেনি। স্বজন হত্যার বিচার না পেয়ে বর্তমানে হতাশায় দিন কাটছে এই পরিবারগুলোর।
সেদিনের ঘটনায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে জীবন নিয়ে আসা ইউনুছ মিয়া এই মামলার বাদী। তিনি জানিয়েছেন,‘যখন আমরা সেখানে যাই, তখন তারা সবার হাত বাঁধতে শুরু করে। বিষয়টি যখন বুঝতে পারি, তখন আমার হাতে ব্যথা বলে অভিনয় করি এবং আমাকে ওরা হালকাভাবে বাঁধে। অনেকক্ষণ পর পর এক-একজনকে একটু দূরে নিয়ে যাচ্ছে। আর চিৎকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবতেছি জীবন তো শেষ। সুযোগ বুঝে চোখ বুজে দিলাম দৌঁড়। দৌঁড় দিয়ে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকলাম। রাতে গ্রামে ফিরে এসে সবাইকে ঘটনা বলি। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করেনি। সকালে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা হতে থাকে। দুদিন পর ১১ সেপ্টেম্বর পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ স্থানীয় লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের লাশ উদ্ধার করে। পরে আমি বাদী হয়ে বাঘাইছড়ি থানায় মামলা দায়ের করি। ’
নিহত ৩৫ কাঠুরিয়ার মধ্যে একজন ছিলেন ফজলুল হক। তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে। তখন ছোট মেয়েটার বয়স ছিল মাত্র ৪০ দিন।কাঠ কাটার জন্য আমার স্বামীর পাহাড়ে দাওয়াত ছিল বলে সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে না আসায় পরদিন সকাল থেকে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করি। পরে দুপুরে খবর পাই যারা গিয়েছে, তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। তিন দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর আমার স্বামীর লাশ পাওয়া যায় এবং ওইদিন বিকালেই দাফন করা হয়। সরকার সেই সময় আমারে পুনর্বাসন করার কথা বললেও এখন পর্যন্ত আমাদের কোনও খবর রাখেনি। ’রাবেয়া বেগম বলেন,‘আপনি দেখেন, গত বছর লংগদুতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মাত্র ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছি।’
একই ঘটনায় নিহত গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী যখন মারা যায়, তখন ছোট দুই মেয়ে ও দুই ছেলে রেখে যায়। কী যে কষ্ট করে তখন জীবন সংসার চালিয়েছি বলে শেষ করা যাবে না। নিহত প্রতিটি পরিবারের জন্য সরকার যদি চাকরির ব্যবস্থা করে দিতো, তাহলে আমাদের পরিবারগুলো খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে পারতো।’
গুলশাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু নাছির বলেন, ‘ঘটনা শোনার পরপরই আমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাই এবং লাশ উদ্ধার করে লংগদু উপজেলা পরিষদের পাশে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। সেই ঘটনায় ৩৫জন নিহত হলেও ২৮ জনের লাশ পাওয়া যায়। বাকিদের লাশ পাওয়া যায়নি। তখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি দল লংগুতে আসে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের কথা বলেছিল। আজও তা করা হয়নি।