॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥
জজ আদালতের রায়, ইউএনওর লাল পতাকা এবং জেলাপ্রশাসকের দুই দুইবারের নির্দেশের পরও নিজের পৈত্রিক ভিটেমাটিতে উঠতে পারেনি লংগদুর রফিকুল। দীর্ঘ ১৫ বছর মামলা চালিয়ে নিঃস্ব রফিক এখন দিন মজুর। পিতার বৈধ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে রাঙামাটি শহরে ঠেলাগাড়ি ঠেলে পরিবারের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে দিনরাত পরিশ্রম করছে। ফাঁকে ফাঁকে প্রসাশনের কর্তা এবং নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ফিরে তার অধিকার প্রার্থনা করছে।
পত্রিকা অফিসে বসে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রফিকুল জানালো তার জমি থেকে কয়েকদিন আগেও বিপুল পরিমাণ ধান কেটে ঘরে তুলেছে অবৈধ দখলদারেরা। অথচ আদালতের রায় বাস্তবায়িত হলে এই ধান তার ঘরে উঠতো।
কাগজপত্র পর্যালোচনা ও সরেজমিন তদন্তে দেখা যায়, লংগদু উপজেলার গুলশাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মৃত ইসরাফিল ১৯৮৪ সালে কবুলিয়াতমূলে সরকার থেকে ২ (দুই) একর ভূমি বন্দোবস্তি পায়। পিতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ সূত্রে মালিকানা পাওয়া ওই জমির চাষযোগ্য অংশ এক সময় সম্পূর্ণ গায়ের জোরে দখল করে চাষাবাদ শুরু করে দেয় একটি চক্র। রফিকুলেরা তিন ভাইয়ের মধ্যে বাকি দুই ভাই সহজ সরল এবং ভীতু প্রকৃতির।
স্থানীয়ভাবে তারা কিছুদিন দরবার সালিশ করে সুবিধা করতে না পেরে বাকি দুই ভাই মনের দুঃখে রাঙামাটি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু রফিকুল তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নামে। স্মরণাপন্ন হয় বিজ্ঞ আদালতের; উৎপত্তি হয় সিভিল মামলা নং-২০৪/১০। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে বাস্তুভিটার একটি অংশ (০.২৫ শতক) সামান্য টাকায় বন্ধক রাখে সে। সেটা তার জন্য আরো কাল হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে ভিটেমাটি হারা হয়ে পড়ে রফিকুল। তারপরও দিনমজুরী করে দীর্ঘ ১৫ বছর মামলা চালিয়ে ডিক্রি অর্জন করে সে। বিজ্ঞ আদালতের রায়ে রফিকুলকে ভূমির বৈধ মালিক এবং অন্যদের অবৈধ দখলদার আখ্যায়িত করে ডিক্রি জারি হয়। এর পর কেটে গেছে আরো ৫ বছর; এখনও রফিকুল মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ফিরছে।
৭ জানুয়ারি ২০১৮ রাঙামাটির বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সে রায়টিতে (৩৮৬ নং গুলশাখালী মৌজা হোল্ডিং নং ১০৪৪) বাদীর স্বত্ব এতটাই স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, দখলদারেরা আর আপীলও করার সুযোগ পায়নি।
রায়ের দেড় বছর পর লংগদুর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও আদালতের নাজির সরেজমিনে জমি পরিমাপ করে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়ে আসলেও (জারি মামলা নং ৫৯/১৮) সরকারি কর্মকর্তাদের বিদায়ের পরপরই দুঃসাহসিকভাবে লাল পতাকা এবং সরকারি বিজ্ঞপ্তি কুপিয়ে অপসারণ করে দখলদারেরা। এই দুঃসাহসের বিচার আজও রফিকুল পায়নি। এই বিচার নিয়ে সে জেলাপ্রশাসকের দারস্ত হলে রায়ের কপি দেখে জেলাপ্রশাসক ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইউএনও লংগদুকে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু একবার উপজেলা ভূমি অফিস, একবার থানা, একবার পুলিশ ফাঁড়ি এভাবে চরকির মতো ঘোরাতে থাকেন কর্মকর্তারা। হালে পানি না পেয়ে আবারও ডিসি বরাবরে আবেদন করে রফিক। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও ইউএনওকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন ডিসি। কিন্তু আগের চরকিতেই ঘুরতে থাকে রফিক। শেষ পর্যন্ত সে গিয়ে পৌঁছে এসপি অফিসে, সেখান থেকেই কেউ সিআর মামলার পরামর্শ দেয় রফিককে।
পরে চলতি বছরের মার্চে রাঙামাটি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি সিআর মামলা রুজু করে রফিকুল। এতে বিবাদী করা হয়েছে কাশেম, মোতালেব, জামাল, হবি মিয়া, ইয়ানুর, রোমানা খাতুন, হালিমা ও রাজ্জাককে।
রফিকুলের আকুতিতে প্রতিবেদন তৈরির জন্য সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রফিকুলের কাগজপত্রে উল্লেখিত চৌহদ্দির ভূমিতে বর্তমানে নয়টি পরিবার কাঁচা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। তাদের ভাষ্যমতে কয়েক বিক্রির পর তারা মালিক হয়েছেন। তবে কেউই মালিকানার স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজ দেখাতে পারেনি। কাগজের কথা বলার সাথে সাথে সটকে পড়ে তারা । এরমধ্যে শুধুমাত্র একজন একটি ১০০ টাকার ট্যাম্পে দখলসত্ত্ব কিনে ২৫ শতক জায়গার মালিকানা দাবি করলেও রফিকুলের ভাষ্য অনুযায়ী সে এমন কোনো স্ট্যাম্প কাউকে দেয়নি।
এরই মাঝে রফিকুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৭/০৫/২০০৮ তারিখে ভূমি মন্ত্রাণলয়ের তৎকালীন উপ-সচিব এস এম আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক পত্রে পাশ্ববর্তী অকৃষি খাস জমি থেকে তাকে আরো দুই একর ভূমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তি প্রদানের জন্য রাঙামাটির জেলাপ্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সেই জমিও এখন আর রফিকুলের দখলে নেই। দিনমজুর রফিকুলের একটাই প্রশ্ন গরীবের জন্য কি বিচার নেই?