আমার প্রিয় গুণীজন মকছুদ দা

489

॥ নুরুল আবছার ॥

যতটুকু মনে পড়ে ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসের প্রথক দিকে একজন যুব বয়সী লোক আমার গৃহশিক্ষক এর সাথে আমাদের তবলছড়িস্থ নিচের বাজারের (হাজী গোলাম কাদের সড়ক) বাসায় আসলেন। আমাদের বাসায় আমি ও আমার জেটাত ভাই ফরিদ থাকতাম। মঝেমধ্যে আমার চাচা স্যার আশুতোষ কলেজের প্রিন্সিপাল সোলাইমান ও আমার বাবা থাকতেন। তবলছড়ি ও রিজার্ভ বাজারে আমাদের দোকান থাকায় আমার জেঠা হাজী গোলাম কাদের তবলছড়িতে কাপড়ের দোকান এবং আমার বাবা রিজার্ভ বাজারে বাটা জুতার দোকান করতেন।
আমার শ্রদ্ধেয় গৃহশিক্ষক মালাকুতুর রহমান পরিচয় পর্বে বলেন এই আমার খালাতো ভাই মকছুদ। আমি ও আমার ছোট ভাই ফরিদ সালাম করলাম। এর মধ্যে নিজের অজান্তে কখন মকছুদ সাহেবকে মকছুদ দা বলে সম্বোধন করেছি তা আমার জানা নেই। কিন্তু আজ অবধি তাকে মকছুদ দা বলে ডেকে আসছি। তিনি বাসায় আমার বিছানায় ঘুমাতেন আমাদের সাথে খেতেন। অনেকদিন আমাদের বাসায় ছিলেন। ছিলেন পরিবারের সদস্য হিসেবে। কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ার পরও রাঙামাটি আসলে আমাদের বাসায় প্রায় সময় থাকতেন।
তৎকালীন সরকার এই পার্বত্য অঞ্চল তথা এই পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিছেলেন। কিন্তু শিক্ষকতার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক এলাকায় পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া সেই সময় শিক্ষকদের বেতন কম থাকায় এই পেশায় আসতে যুবকদের আগ্রহ ছিল না।

আমাদের গৃহশিক্ষক মালাকুতুর রহমান আমাদেরকে ধর্মশিক্ষাসহ সব বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। তখন তিনি রিজার্ভ বাজারস্থ কায়েদ ই আযম মেমোরিয়াল একাডেমীতে (শহীদ আব্দুল আলী একাডেমী) হেড মাওলানা হিসেবে শিক্ষকতা করতেন। তাঁর নিজ বাড়ী চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই থানাধীন ইছাখালী গ্রামের সারেং বাড়ী। আমাদের গৃহশিক্ষক বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদেরকে শিক্ষাদান করে আসছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন বিশ্বাসী তেমনি ছিলেন ধার্মীক। তাই তাকে আমাদের পারিবারের মুরুব্বিরা আমাদের অভিভাবক হিসেবে রেখে দেন। আমাদের গৃহশিক্ষক রাঙামাটিতে দীর্ঘদিন অবস্থান করায় রাঙামাটি শহরটি তার কছে ভালো লেগে যায়। তাই একদিন তার খালাতো ভাই মকছুদকে রাঙামাটি বেড়াতে আসতে বলে। আর তাই মকছুদ দা রাঙামাটি আসলেন।

মকছুদ দা দেখতে বেশ স্মার্ট না হলেও তিনি খুব সুদর্শন ছিলেন। তখন একদিন কথা প্রসঙ্গে জেলার প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে আলাপ হয়। সে সময় জেলা স্কুল পরিদর্শক (ডিপিইও) ছিলেন আলী আহমদ। আমাদের হুজুরের সাথে পরিদর্শক স্যারের ভালো পরিচয় ছিল। একদিন তিনি মকছুদ দাকে শিক্ষা অফিসে নিয়ে যান এবং স্কুল ইন্সপেক্টরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

ইন্সপেক্টর সাহেবের সাথে আলাপকালে মকছুদ দার ব্যবহার আচার আচরণ ও বুদ্ধিমত্তা দেখে তিনি মকছুদ দাকে শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী কিনা জানতে চান। মকছুদ দা শিক্ষকতা করতে সম্মতি জানান।
১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালী উপজেলাধীন কলমপতি মৌজার বেতছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে লংগদু থানাধীন সোনাইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৯৬৯ সালে বরকল থানাধীন গোরস্থান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পশ্চাৎপথ পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। তাছাড়া শিক্ষকতা পেশায় স্থানীয়দের আগ্রহ কম থাকায় মকছুদ দা ও তার খালাতো ভাই (গৃহশিক্ষক) অন্য জেলার বেকার যুবক যুবতীকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ সহায়তা প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে, অত্র এলাকার জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বচ্ছল না থাকার কারণে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করার ও আগ্রহ ছিল না।

১৯৩৬ সালে অত্র অঞ্চলের প্রথম প্রকাশিত সাময়িক পত্রিকা “গৌরিকা”। গৌরিকা প্রকাশ করেন চাকমা সার্কেল চীফ এর ঠাকুর মা প্রয়াত বিনীতা রায়। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাধ সম্পন্ন হলে বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার হাজার হাজার একর জমি, বসতবাড়ী, রাঙ্গামাটির মূল শহরসহ সমস্ত কিছু কাপ্তাই হ্রদে তলিয়ে যায়। মানুষ হয়ে পড়ে উদ্ভাস্থ। এমতাবস্থায় সাহিত্য সংস্কৃতির কথা বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী বাবু বিরাজ মোহন দেওয়ান রাাঙ্গামটি নতুন শহরের তবলছড়ি বাজার সংলগ্ন এলাকায় একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। ঐ বছরই এই ছাপাখানা হতে “গিরিশিখর” নামে একটি সাময়ীকি বান্দরবান থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৮ সালে রাাঙ্গামাটি হতে এ কে এম মকছুদ আহমদের সম্পাদনায় “সপ্তাহিক বনভূমি” প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সালে কাজী খলিলুর রহমান “সাপ্তাহিক সমতা” প্রকাশ করেন। ১৯৮১ সালে পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম “দৈনিক গিরিদর্পণ” এ কে এম মকছুদ আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

বর্তমান আধুনিক কম্পিউটার ও বিশেষ ছাপাখানার ব্যবস্থাপনায় অতিসহজে দৈনিক, সপ্তাহিক, ও বিভিন্ন সাময়ীকি প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে যা কল্পনা ও করা যায়নি।। তখনকার সময়ে প্রেসের বিভিন্ন ব্লগ শিশার অক্ষর থেকে শব্দ সংগ্রহ করে খবরের ফরম্যাট তৈরী করতে হতো। যা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ও পরিশ্রমের ব্যাপার। এ কে এম মকছুদ আহমদ এই কষ্টকে কাঁধে নিয়ে চট্টগ্রামের প্রেসে কোন সময় বিদ্যূৎ লাইটে কোন সময় কুপি বাতির আলোতে ব্লগ তৈরীতে সহায়তা করতেন। এক পর্যায়ে এ কে এম মকছুদ আহমদ শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে সংবাদপত্র প্রকাশনার দিকে মনোনিবেশ করেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক বনভূমি ও দৈনিক দিরিদর্পণ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশনা ছিল তার নিকট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পত্রিকা প্রকাশের জন্য অর্থনৈতিক সংকট ছিল প্রকট। এতদ অঞ্চলের সর্বসাধারন ও প্রশাসনর একমাত্র যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যম ছিল এই পত্রিকা। এই পত্রিকা দুইটি প্রকাশে এ কে এম মকছুদ আহমদকে বহু ঝড়ঝঞ্চা ও চ্যালেঞ্জের মূখোমূখী হতে হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের বাশ কাটিয়েদের দাস শিবির, আরাকান রোহিঙ্গাদের সমস্যা যেমনিভাবে তার পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন তেমনিভাবে অত্র জেলার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রময় জীবনধারা, সাহিত্য, সংস্কৃতি তার পত্রিকায় স্থান পায়। অত্র জেলার কৃষি, কুটির শিল্প ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের বিষয়ে ও তার পত্রিকায় বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে আমরা কয়জকন জাতীয় দৈনিক পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রেরণ করি। এই সৌখিন সংবাদ দাতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রয়াত ডঃ আলো রানী আইচ, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ফরিদুল ইসলাম লতিফী এবং কাপ্তাইয়ের এক ভদ্রলোক যার নাম এখন মনে নেই। আমরা সংবাদ দাতা হিসেবে এলাকার সংবাদগুলি পাঠাতাম। রাজনৈতিক কোন সংবাদ প্রেরণ করা হতোনা। এই সময় বাংলাদেশ সংবাদ দাতা সমিতির সভাপতি শফিউদ্দীন আহমদ রাঙ্গামাটিতে এসেছিলেন এবং আলো দিদির বাসায় দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। আমি প্রথমে দৈনিক বাংলাদেশ এবং দৈনিক বাংলার বাণীতে সংবাদ প্রেরণ করি। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ এর ঘটনার পর হতে আমি বাংলার বাণীর সাথে যোগাযোগ রাখিনী। জাতীয় প্রেস কাউন্সিলের প্রশিক্ষণ বিভাগ সাংবাদিকতার উপর প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করলেও ব্যক্তিগত অসুরিধার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। আগের মত বিভিন্ন স্মরনিকা, ম্যাগাজিন ও স্থানীয় দৈনিক সমূহে মাঝে মধ্যে কিছু লেখার চেষ্টা করি।

১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। দীর্ঘ এক যুগের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে এ কে এম মকছুদ আহমদ তার লেখনির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ, ভূমিকা পালন করেন।

এ কে এম মকছুদ আহমদ দীর্ঘদিন রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার সাংবাদিকতা পেশায় দায়িত্ব পালনকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সনামধন্য বিবিসি সম্পাদক মার্ক টালির সাথে ও আমি তাকে দেখেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তক্ষয়ী সংঘাত প্রসমনে এবং শান্তিচুক্তির স্বপক্ষে তার লেখনি ও প্রকাশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে একজন সৎ নিষ্ঠাবান ও নির্ভীক কলম সৈনিক হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
সাংবাদিকতা পেশা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগটনের সাথে সংযুক্তি থেকে দেশ সেবার দায়িত্ব পালন করেন। এ কে এম মকছুদ আহমদ বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির (এফপিএবি) সভাপতি, বাংলাদেশ স্বাউটস, রাঙামাটি জেলা রোভার স্কাউটসের সহকারী কমিশনার ও সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিরাপন সড়ক চাই ও ধুমপান নিবারন সংগঠন (আধুনিক) এর সহ সভাপাতি। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিবন্ধিদের জন্য ২০০১ সালে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত রাঙ্গামাটি প্রতিবন্ধী স্কুল ও পূর্নবাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও কার্যনির্বাহী কমিটির সহ সভাপতি এবং প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা প্রাপ্ত ব্যক্তি।

এ কে এম মকছুদ আহমদ এর জীবন যৌবন জীবন জীবীকা মিশে আছে এই পার্বত্য অঞ্চলে। আমার পরিবার কাপ্তাই হ্রদ উদ্ভাস্থ পরিবার। পরিচয় সূত্রে মকছুদ সাহেবের পরিচয় হলেও জীবন চলার পথে পরিবারের সদস্য হিসেবে একজন আরেজনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। একে অন্যের সুখ দূঃখের সাথী হই। তিনি আমার বড় ভাই আমার মকছুদ দা।

এ কে এম মকছুদ আহমদ একজন বিনয়ী সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রেমিক পুরুষ। তিনি হৃদয়বান ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী। অর্থলোভ ও ধর্মীয় উম্মাদনা থেকে তিনি ছিলেন অনেকটা দূরে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কিছু তার কাম্য ছিলনা। খুব কাছ থেকেই দেখেই আমি তাকে যতটুকু দেখেছি সহজ-সরল ও সাদামাটা তার জীবন। এর মাঝে ১৯৭৬ মালের ৬ ডিসেম্বর আরেক সহজ সরল উদার মনের অধিকারী আমার স্কুলজীবনের সহপাটি মঞ্জু রাণী গুর্খাকে তিনি বিয়ে করেন।

এ কে এম মকছুদ আহমদ হলেন পার্বত্য অঞ্চল তথা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি অনেক সম্মাননা ও স্মৃতি পদকে ভূষিত হন। তিনি একজন সাংবাদিক এবং পত্রিকার সম্পাদকই নন, তিনি পার্বত্য অঞ্চলের সাংবাদ দাতাদের ও গুরু।

শ্রদ্ধেও মকছুদ দাকে জীবন চলার পথে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ও একজন বিশস্ত বন্ধু ও সাথী হিসেবে পিয়েছি। পেয়েছি পরিবারের একজন সদস্য ও বড়ভাই হিসেবে। তিনি আমার শ্রদ্ধার আসনে আছেন, থাকবেন আজীবন।

[লেখক: রোভার স্কাউট, রাঙামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক]