ঈদ অবকাশের চারদিনে রাঙামাটির পর্যটন খাতে শতকোটি টাকার লেনদেন

383

॥ আলমগীর মানিক ॥

পাহাড় আর হ্রদের অপরূপ মেলবন্ধনের শহর পার্বত্য রাঙামাটির নৈসর্গিক সৌন্দয্য উপভোগ করতে গত তিনদিনে প্রায় অর্ধলক্ষ পর্যটকের আগমন ঘটেছে অত্রাঞ্চলে। বৈরি আবহাওয়ায় ঈদের পরদিন রাঙামাটিতে পর্যটকদের আগমন তেমন একটা দেখা নাগেলেও দ্বিতীয়দিন থেকে রোববার পর্যন্ত রাঙামাটিতে গড়ে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার পর্যটকের আগমন ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট্যদের সাথে কথা বলে জানাগেছে। এতে করে উক্ত পর্যটকদের মাধ্যমে অন্তত শতকোটি টাকার মতো আয় হয়েছে সংশ্লিষ্ট্যদের। পার্বত্য অর্থনীতিতে নতুন করে গতির সঞ্চার হয়েছে বলেও মনে করছেন অত্রাঞ্চলের ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ।

ভূ-প্রাকৃতিক ভিন্ততার পাশাপাশি উপজাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ঝুলন্ত ব্রীজের শহর হিসেবে দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে পার্বত্য রাঙামাটির পরিচয় থাকলেও বিগত কয়েক দশকেও অত্রাঞ্চলের পর্যটন সেক্টরে দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট্য কর্তৃপক্ষ। পাহাড়ে বিশেষায়িত আইন ব্যবস্থা ও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের নানামুখি চাঁদাবাজি, সশস্ত্র তৎপরতার কারনে এমনিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের সমতল এলাকাগুলো থেকে এখনো পর্যন্ত পিছিয়েই রয়ে গেছে। তার উপর বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় বাজার ফান্ডের ভূমি রেজিষ্টেশন বন্ধ থাকা, কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ আহরন-বিপনন বন্ধসহ খরায় কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে আট উপজেলার সাথে নৌ যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় কাঠের ব্যবসাও অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসা, সর্বোপুরি রডের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অত্রাঞ্চলে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড অনেকটাই বন্ধ হয়ে থাকায় রাঙামাটির অর্থনৈতিক অবস্থায় চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে বর্তমান সময়ে। এমনি সময়ে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমনে পাহাড়ের অর্থনীতি নতুনভাবে গতি সঞ্চারিত হয়েছে বলে মনে করছেন অত্রাঞ্চলের ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ।

রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক এবং আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির নেতা ও হোটেল প্রিন্স এর স্বত্তাধিকারী নেসার আহাম্মেদ জানিয়েছেন, রাঙামাটিতে ৪৫টি আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি আরো প্রায় ২০ থেকে ৩০টি কটেজ, হোমবেড সিস্টেমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পর্যটকদের রাত্রিযাপনের সুবিধা রয়েছে। তিনি বলেন, গড়ে ১০ হাজার পর্যটক রাঙামাটিতে অবস্থান করতে পারে। রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অত্রাঞ্চলে কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমন, পাহাড়ি রেষ্টুরেন্টগুলোতে ঐতিহ্যবাহি খাবারের ব্যবস্থা, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বস্ত্র ক্রয়, বেসরকারিভাবে গড়ে উঠা ট্যুরিষ্ট স্পটগুলো, শহরের অভ্যন্তরে অটোরিক্সা, কার মাইক্রো দিয়ে ঘুরাফেরা, শহরের রেষ্টুরেন্ট, হোটেল-মোটেলগুলোতে খাবারগ্রহণ, গাড়ি ভাড়া, বোট ভাড়া, রুম ভাড়া ও বস্ত্র ক্রয়ের মাধ্যমে গড়ে অন্তত ২ হাজার টাকা করে ব্যয় করে অধিকাংশ পর্যটকরা। ভিআইপি শ্রেণীর পর্যটকরা আরো বেশি খরচ করছেন। এতে করে গত চারদিনে রাঙামাটিতে সংশ্লিষ্ট্য পর্যটক নির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় শতকোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এটা আমাদের রাঙামাটির অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করেছে।

এদিকে, রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়–য়া জানিয়েছেন, এবারের ছুটিতে তাদের পর্যটনের ৭০ শতাংশ রুম ভাড়া হয়েছে এবং গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ পর্যটক টিকেট কেটে ঝুলন্ত সেতু দেখতে গিয়েছে।

অপরদিকে, রাঙামাটি ট্যুরিষ্ট পুলিশের ইউনিট প্রধান ইন্সপেক্টর জহিরুল আনোয়ার জানিয়েছেন, এবার প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটেছে রাঙামাটিতে। এতে করে ট্যুরিষ্ট পুলিশের পক্ষ থেকে পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। ট্যুরিষ্টদের নিরাপত্তায় যাবতীয় সকল নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে। তাই কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।

রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের বিনোদনের জন্য রয়েছে, পর্যটনের ঝুলন্ত ব্রীজ, রাঙামাটি জেলা পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত পলওয়েল পার্ক, জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত রাঙামাটি পার্ক, সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত আরণ্যক রিসোর্ট, ডিসি বাংলো, বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ, শহরের ভেদভেদির মিনি চিড়িয়াখানা, রাজবন বিহার, কাপ্তাই লেক, সুভলং ঝর্ণা, পেদাটিংটিং, টুকটুক, রাইন্যাটুগুন, বার্গি লেক, বেড়াইন্ন্যা, ইকোভিলেজসহ কাপ্তাই লেকের পাড়ে গড়ে উঠা বিভিন্ন পর্যটন স্পট। দুই বছর পর আবারও মুখর রাঙামাটির পর্যটন স্পটগুলি। লাখো পর্যটকের ঢল নেমেছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে। বিনোদন কেন্দ্রগুলো পর্যটকদের পদচারণে অনেকটাই মুখরই বলা চলে।

এদিকে, বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত পর্যটন কমপ্লেক্স এলাকায় সেই মান্দাতা আমলে ঝুলন্ত ব্রীজটি দন্ডায়মান ছাড়া দৃশ্যমান আর কোন উন্নয়ন না হলেও রাঙামাটিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটন খাতে কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন করা হয়েছে। এসব স্থানেই মূলত পর্যটকদের বেশী ভিড়। রাঙামাটিতে পর্যটনের প্রত্যাশিত উন্নয়ন না হওয়া এবং রাঙামাটির সরকারী বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারনে বছরের ৫টি মাস রাঙামাটিতে পর্যটকদের আগমন থাকলে ও বাকী ৭টি মাস অনেকটাই বসে বসে দিন কাটান এর সাথে সংশ্লিষ্টরা।

রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট্যরা বলছেন, রাঙামাটির প্রকৃতির প্রতি দেশ ও বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ দিনদিন বাড়ছেই। সেদিকে খেয়াল রেখে বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাদের পর্যটন সংশ্লিষ্ট্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হোটেল-মোটেল, রিসোর্টগুলো তৈরি করছে তার সাথে সাথে অত্রাঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে ট্যুরিষ্ট ও নৌ-পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা যায় তাহলে অত্রাঞ্চলে পর্যটকদের আগমন বহুগুন বাড়বে পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যটন মন্ত্রনালয়, জেলা পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট্য কর্তপক্ষগুলো যদি ঋণ প্রদান, বা পরামর্শ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে তাহলে এখানকার পর্যটন সংশ্লিস্ট্য উদ্যোক্তারা এই শিল্পের আরো প্রসারে এগিয়ে আসার উৎসাহ পাবে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।