নয়নাভিরাম রাঙামাটি জেলার সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ি উপজেলার আমতলী ইউনিয়নটি মূলতঃ বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। জনসংখ্যা কম হলেও সমতলের মতই সকল ধরনের চাষাবাদ হয় এই এলাকাটিতে। কৃষি নির্ভর এই পরিবারগুলোর চাহিদা খুব সিমীত। মোটাভাত মোটা কাপড় পরে সন্তান সন্ততি মানুষ করতে পারলেই খুশী তারা। এই লক্ষ্যে তারা নিজেদের ঘামঝরা টাকা খরচ করে এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।
কিন্তু এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘিরেও রাসেল চেয়ারম্যানের ঘৃণ্য রাজনীতি এখানকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কলুষিত করে রেখেছে। চেয়ারম্যান হবার অনেক আগে থেকেই পেটোয়া বাহিনী আর টুপাইস লোভী পুলিশের সহযোগীতায় পুরো এলাকায় মুকুটহীন স¤্রাট সেজে বসে তরুণ রাসেল। তখন সে ছিল ছিছকে মাস্তান টাইপের উঠতি ছাত্রনেতা।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনি কল্যাণমুখী তথা দুঃখী মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে শুরু করেন ডন হয়ে ওঠার কসরত। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গ্রামীণ এই মানুষগুলোর মাঝে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।
আমতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক খোকন জানান, আগের ইতিহাস শুধু শুনেছি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের এলাকায় দিন দিন রাসেলের অত্যাচার বেড়েই যাচ্ছে।
তার অত্যাচার থেকে বাঁচতে শেষ পর্যন্ত আমরা জেলা আ’লীগের কাছে তার বিরুদ্ধে ইউনিয়ন আ’লীগ ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে একটি অভিযোগ পত্র প্রদান করি। জেলা আ’লীগের পক্ষ থেকে রাসেলের কর্মকান্ড সম্পর্কে জানার জন্য চার সদস্যর একটি তদন্ত টিম বাঘাইছড়ির আমতলী ইউনিয়নে আসলে আমরা রাসেলের সীমাহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং অত্যাচারের কথা তদন্ত টিমকে প্রমাণসহ বিস্তারিত জানিয়েছি।
তিনি বলেন, চেয়ারম্যান রাসেলের ছোট ভাই বেল্লাল ওরফে কালেক্টর বেলাল তার লোকজন নিয়ে চলতি বছরের ১আগস্ট সন্ধ্যায় আমতলী ইউনিয়ন বাজারে আমার উপর অতর্কিত হামলা চালালে আমি বাজারের ভিতর আশ্রয় নেই। এসময় তারা আমাকে প্রায় দুই ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসলে তারা পালিয়ে যায়।
ছাত্রলীগের এ নেতা জানান, চেয়ারম্যান রাসেলের ছোট ভাই বেলাল চেয়ারম্যান রাসেলের নির্দেশে মাছের বোট থেকে চাঁদা আদায় করে। তিনি জানান, এ ঘটনার পর আমি আর বাড়িতে যেতে পারিনি। আমতলী ইউনিয়ন মহিলা আ’লীগের সভানেত্রী ও ১.২.৩ নং সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর রাবেয়া বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়।
এরপর নেতা-কর্মীদের পরামর্শে ৩আগস্ট বাঘাইছড়ি থানায় তার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরী করলে রাসেলের লোকজন ওইদিন রাত দুইটার দিকে আমার বাড়িতে হামলা চালায় এবং আমার নগদ টাকা এবং স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। ছাত্রলীগের এ নেতা জানান, আমি এখনো ভয়ে আছি। কারণ এর আগে যেই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে তাকে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে।
তাই চেয়ারম্যান রাসেল আমাকে কখন আবার হামলা করে এই ভয়ে আছি, তবে আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে দলের ভাবমূর্তি এবং এলাকার মানুষের স্বার্থে সোচ্চার হতে বাধ্য হয়েছি। এ বিষয়ে উপজেলা আ’লীগ ও উপজেলা ছাত্রলীগকে জানানো হয়েছে। রাসেলের অত্যাচার থেকে তিনি মুক্তি চাই বলে জানান।
রাসেল চেয়ারম্যানের সাথে তার বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যানদের অভিযোগসহ অন্যান্য অভিযোগগুলো নিয়ে কথা বলা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে স্বপ্রতিভভাবেই বলেছেন, এই সকল অভিযোগ মিথ্যা এবং বানোয়াট। আমি আসলে এলাকার উন্নয়ন কিভাবে হবে এই চিন্তাতেই আমার সময় পার করি।
নিজে উন্নয়ন কাজে অংশ গ্রহণ করি এবং সরকারি সহায়তা নিয়ে আমার ইউনিয়নটিকে উন্নয়নের গতিধারায় নিয়ে আসার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তিনি অভিযোগ করেন, একটি মহল চায় না এই এলাকার উন্নয়ন হোক মানুষ সুখে থাকুক। তাই তারা আমার সাফল্যে ইর্সান্বিত হয়ে এসব কাল্পনিক অভিযোগ তুলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা লিখিতভাবে চ্যালেঞ্জ করে বলেছে, রাসেলের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তিনি দীর্ঘদিন এলাকায় দীর্ঘদিন নিজেকে উচ্চ শিক্ষিত দাবি করেছেন। কিন্তু আর্মিক্যাম্পে যখন তিনি নিজের অস্টম শ্রেণি পাশের বিষয়টি স্বীকার করেন, তখন সেখানে কয়েকজন ইউপি সদস্য ছিল তারা বিষয়টি মুনে ফেলে।
এ ছাড়া এই চেয়ারম্যান যেসব জাল সনদ জমা দিয়ে আইন কলেজে ভর্তি হন তা আমতলীবাসীর হাতে হাতে রয়েছে। সনদ ভূয়া হওয়ায় ইতোমধ্যে আইন কলেজ থেকে তার ভর্তিও বাতিল করা হয়েছে।
এলাকার মানুষ জানিয়েছে গত ১৪ আগস্ট রাসেল তিন সন্তানের জননী যে নারীকে বিয়ে করেছে বলে জানা গেছে, তার বাইরেও ওই চেয়ারম্যান আরো ৬/৭টি বিয়ে করেছে বলে এলাকাবাসী দাবি করেন। ওই নারীকে ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করার প্রলোভন দেখিয়ে চেয়ারম্যান বেশ আগেই মহিলাকে তার ঢাকায় অবস্থানরত স্বামীর কাছ থেকে ভাগিয়ে এনে আমতলীতে বসবাস করার পরামর্শ দেয়। তিনি দীর্ঘদিন চেয়ারম্যানের সহচর ছিলেন। নির্বাচনে হেরে যাবার পর এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
পরে তিনি মহিলাকে নানাভাবে নাজেহাল করার চেষ্টা করলে শেষ পর্যন্ত ওই মহিলা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে আবেদন জানায়। পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে পুলিশি স্কট নিয়ে ওই নারী এলাকায় ফিরতে বাধ্য হন।
মুঠোফোনে (….নামের) ওই নারীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি আমার জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে এই বিষয়গুলো আপাতত কিছু বলছিনা। তবে খুব সহসাই প্রয়োজনে আমি সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়গুলো আপনাদের জানাবো।
বাঘাইছড়ি উপজেলা আ’লীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক ও ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হোসেন জানান, চলতি বছরের ১৩ জুলাই একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সামান্য কথাকাটি-কে কেন্দ্র করে ১৩ জুলাই বিকেলে আমতলী ইউনিয়ন বাজারে রাসেলের লোকজন লাটিসোঠা নিয়ে আমার উপর হামলার চালালে আমি প্রাণভয়ে বাঘাইছড়ি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করি।
এ ছাড়া রাসেলের বিরুদ্ধে থানায় একাধি অভিযোগ এবং আদালতে একাধিক মামলা বিচারাধীন আছে। এর মধ্যেই একটি ২০০৬ সালের মামলা, জাল টাকার যে মামলায় তিনি র্যাবের হাতে আটক হয়ে জেল খেটেছেন।
রাসেল এলাকার সরকারি সম্পত্তি যেমন নিজের মতো করে ব্যবহার করেন, তেমনি প্রয়োজন হলে যে কারো বোট যে কারো নির্মাণ সামগ্রী, যে কারো পরিবহন নিজের মতো করেই ব্যবহার করেন। কেউ তার এলাকা দিয়ে কাঠের বোট আনলে যেমন তার ট্যাক্স না দিয়ে আসতে পারে না। তেমনি কেউ ওই এলাকায় উন্নয়ন কাজ করতে গেলেও তাকে বখরা না দিয়ে কাজ করতে পারে না।
আব্দুস সালাম নামে আমতলীর একজন ইটভাটার মালিক দাবি করেন, রাসেল চেয়ারম্যান তার ভাটা থেকে ৩০, হাজার ইট বাকীর কথা বলে নিয়ে গিয়ে বাড়ি তৈরী করেন। কিন্তু ইটের টাকার পরিশোধের কথা তার সামনে উচ্চারণও করা যাচ্ছে না।
প্রশাসনের কাছে ৮ ইউপি সদস্যের করা অভিযোগপত্রে জানানো হয়, চেয়ারম্যান রাসেল ভিজিডি কার্ড করে দিবে বলে ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রতিজন মেম্বার থেকে ওই এলাকার ২০-৩০জনের নাম নেয় এবং তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি এক হাজার টাকার বিনিময়ে তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করে।
অনেকে টাকা দিতে না পারলে ভিজিডি পাচ্ছে না। অভিযোগ পত্রে জানানো হয়, এ দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী রাসেলের হাত থেকে তারা মুক্তি চান। প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই বিচারের জন্য আবেদন করতে বাধ্য হবেন।
এ বিষয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাজুল ইসলাম জানান, আমতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠানো ছাড়াও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
রাসেলের বিরুদ্ধে করা একাধিক মামলার বিষয়ে বাঘাইছড়ি থানায় খবর নিয়ে পাওয়া গেল এক লম্বা হিসাব। অনলাইনে সকল মামলার হিসাব রয়েছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হোসেন জানান, আমতলীর চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীর বিষয়টি নিয়ে জেলা আ’লীগ দেখভাল করছে। তিনি জানান, সম্প্রতি জেলা আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমির উদ্দীনের নেতৃত্বে চার সদস্যর একটি তদন্ত টিম রাসেল চৌধুরীর বিষয়টি নিয়ে বাঘাইছড়ি এসে ঘুরে গেছেন। (চলবে..