ঐতিহ্যবাহী রাঙামাটি রাজবন বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পন্ন

470

॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥

মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে লাখো পূর্ণার্থীর শ্রদ্ধা এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীয্যের মধ্যদিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ৪৮তম কঠিন চীবর দানোৎসব রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী রাজবন বিহারে চীবর উৎসর্গের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে।

শুক্রবার (১২ নভেম্বর) বিকেলে রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার প্রাঙ্গনে বৌদ্ধ ধর্মীয় সমাবেশে প্রয়াত পার্বত্য ধর্মীয় গুরু বনভন্তে স্মৃতির উদ্দেশ্যে পার্বত্য ধর্মীয় গুরু বনভন্তের শীর্ষ মন্ডলী ও রাজবন বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরের হাতে চীবর উৎসর্গ করেন রাজবন বিহারের উপাসক উপাসিকা পরিষদের সভাপতি গৌতম দেওয়ান। চীর উৎসর্গের সময় পূর্ণার্থীদের সাধু..সাধু..সাধু কন্ঠধ্বনিতে রাজবন বিহারের সমগ্র আশপাশে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

বিহার প্রাঙ্গনে আয়োজিত পূণ্যার্থীদের উদ্দেশ্যে পঞ্চশীল প্রদান ও ধর্মদেশনা দেন রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারের ভিক্ষু সংঘের প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরসহ তিন পার্বত্য জেলার বৌদ্ধ পন্ডিত ভিক্ষুগণ। এ সময় তারা বিশ্বের সকল প্রাণীর হিতসুখ ও মঙ্গল কামনায় এবং মহামারি করোনা ভাইরাস থেকে পরিত্রাণসহ কৌশল কর্ম, সৎ চেতনা ও সৎ জীবন নিয়ে জীবনযাপন করার জন্য হিতোপোদেশ দেন।

উক্ত ধমীয় অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, চাকমা রাজ পরিবারের সদস্য চাঁদ রায়, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, জেলা পরিষদ সদস্য সবির কুমার চাকমা, ইলিপন চাকমা, ঝর্ণা খীসা, রাজবন বিহারের কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ সভাপতি নিরুপা দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক অমিয় খীসা উপস্থিত ছিলেন।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে কঠিন চীবর দান ছাড়াও, বুদ্ধমূর্তিদান, সংঘদান, অষ্টপরিষ্কার দান, কল্পতুরু দান, বিশ্বশান্তি প্যাগোডার অর্থ দান, হাজার প্রদীপ দান অনুষ্ঠান।

উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিধেয় গেরুয়া কাপড়কে বলা হয় চীবর। পুণ্যবতি সেবিকা বিশাখা কর্তৃক প্রবর্তিত প্রাচীন নিয়ম মতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে চরকায় সূতা কেটে, সূতা রং করে আগুনে শুকিয়ে সেই সুতায় তাঁতে কাপড় বুনে চীবর তৈরী করে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করা হয় বলে এর নাম কঠিন চীবর দান।

তবে বেইন বুনে চীবর তৈরি করার নিয়ম থাকলেও করোন পরিস্থিতির কারণে গত বছর এবং এ বছর চরকায় সুতা কেটে বেইন বুননের মাধ্যমে কঠিন চীবর তৈরীর অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয় রাজবন বিহার কর্তৃপক্ষ। তাই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ১ দিন ব্যাপী এই চীবর দানানুষ্ঠান শেষ করে। এই পূর্ণানুষ্ঠানে তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা এবং বিদেশ থেকেও প্রতিবছর লাখো পূর্ণার্থীরা অংশ গ্রহণ করেন।

আর ১৯৭৪ সাল থেকে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে চীবর দান হয়ে আসছে। এ উৎসবে যোগ দিতে প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে লাখো মানুষ ভিড় জমায় রাজবন বিহারে। তবে এ বছর করোনার কারণে এবার সে রীতি অনুযায়ী এ উৎসব অনুষ্ঠিত না হলেও পুণ্যার্থীর ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে, দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পূর্বে গৌতম বুদ্ধের শিষ্য বিশাখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে চীবর তৈরীর প্রচলন করেছিলেন। প্রতি বছর আষাড়ী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাস বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস শেষে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চীবর দান করতে হয়। এরইই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সাল থেকে বুদ্ধের শিষ্য বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে ৪৮ বছর ধরে কঠিন চীবর দান উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। রাতে রাজবন বিহারে ফানুষ উড়িয়ে শেষ হবে এই কঠিন চীবর দান উৎসব।