অতি বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া কাপ্তাই হৃদের পানি না কমিয়ে ধরে রাখার কারণে মাথায় হাত পড়েছে হাজার হাজার চাষীর। এতে খাদ্য ঘাটতির এ জেলায় আগামী মওসুমে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জলেভাসা জমি নিমজ্জি থাকায় একদিকে যেমন ক্ষেত শ্রমিকরা বেকার হয়ে রয়েছে অপর দিকে ব্যবসা বাণিজ্যও ঝিমিয়ে পড়েছে।
এদিকে জুনের মাঝামাঝি থেকে জলমগ্ন হওয়া জেলার বিভিন্ন এলাকার সহ¯্রাধিক বাড়িঘরের অধিবাসীরা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। মাসের পর মাস কৃত্রিম খাবার জোগান দিতে গিয়ে কৃষকেরা গবাদি পশুও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষকরা জানায় পানি কমলে তারা ভিটে জমিতে সবজি চাষ করে বছরের এ সময়টিতে যে বাড়তি রোজগার করতেন তাও এ বছর বন্ধ হয়ে গেছে। এতে একদিকে যেমন বাজারে আমদানি করা সবজির দাম চড়ে গেছে তেমনি কৃষকের পকেট গড়ের মাঠে পরিণত হয়েছে।
এই সঙ্কট নিরসনে অবিলম্বে রুল কার্ভ অনুযায়ী পানি বিদ্যুৎ বাঁধ খুলে দিয়ে পানি ছাড়ার দাবি জানিয়েছে জনপ্রতিনিধিরা। তারা অবশ্য অভিযোগ করেন, ১৯৬০ সালের রুল কার্ভের দোহাই দিয়ে যদি এখনও হ্রদে পানির উচ্চতা আগের মতই রাখা হয়। তাতে এসঙ্কটের কোনো সমাধান হবে না। কারণ অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময়ের ব্যবধানে কাপ্তাই হ্রদে পলি জমে এবং পাহাড় ধসে ধসে তলদেশ কয়েকফুট উঁচু হয়ে গেছে। তাই বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গবেষণার মাধ্যমে নতুন রুলকার্ভ নির্ধারণ করা জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের তীরবর্তী ও নিন্ম এলাকায় বসবাসরতদের মধ্যে অন্তত ২৫ হাজার চাষী পরিবার কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। এবছর এই সময়ে এই ধরনের পানি বৃদ্ধিতে জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুড়াছড়ি, বিলাইছড়ি, নানিয়ারচর, লংগদু এই ছয় উপজেলায় বসবাসরত জনসংখ্যার অর্ধেকাংশই বিভিন্ন ভাবে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে বর্তমানে। এই সকল লোকদের মধ্যে চাষের উপর নির্ভরশীল নিন্ম আয়ের পরিবারগুলোতে চলছে চরম দুর্দিন। লংগদু উপজেলায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। অপরদিকে বাঘাইছড়িতেও অন্তত তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বরকলের ভূষণছড়া, কলাবুনিয়া, এরাবুনিয়া এলাকায় পানিবন্দির সংখ্যা অন্তত ১২শ। এদিকে জুড়াছড়ি এলাকায় পানি বৃদ্ধির ফলে চাষের জমি ডুবে যাওয়ায় চাষাবাদ বঞ্চিত হয়েছে কয়েকশ পরিবার। নানিয়ারচরের নিন্ম এলাকাগুলোতে বৃদ্ধিকৃত পানির তলে তলিয়ে গেছে শীত সবজি।
রাঙামাটি কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, কাপ্তাই হ্রদের জলেভাসাসহ হ্রদ তীরবর্তি ৯ হাজার ২শ হেক্টর জমিতে এবার আমন চাষ করা হয়েছে। গত বছর করা হয়েছিলো ৯ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে। কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধির ফলে এবার ৩শ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করতে পারেনি পাহাড়ের কৃষকরা। এতে করে অন্তত ১১শ মেট্রিন টন খাদ্য উৎপাদন কম হবে এবছর। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে গত বছর জেলায় আমনের উৎপাদন হয়েছিলো ৩৩ হাজার মেট্রিন টন।
এছাড়া কাপ্তাই হ্রদের জলেভাসাসহ তীরবর্তী ৯৬২৪ হেক্টর জমিতে আমন পরবর্তী বোরো ধান, শীত সবজি ও তরমুজ চাষের সাথে জড়িত প্রায় ২৫ হাজার কৃষক পরিবার। এদের মাধ্যমেই গত বছরে উক্ত জমিতে আমন ৩৩ হাজার মে:টন, বোরো ধান, শীত সবজি ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, ৮৩৭৮ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়েছে গত বছর।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, এবছরও গত বছরের ন্যায় ফসল উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে তারা ফসল লাগিয়েছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি পরবর্তী এই পানি ধরে রাখায় নিন্মাঞ্চলের কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিরমুখে পরবে। এর ফলে আগামী বছর ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোতে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে জানাগেছে। অবস্থা থেকে শীঘ্রই উত্তরনে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমানোর দাবিও জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট্য কৃষক পরিবারগুলো।
রাঙামাটি কৃষি বিভাগের উদ্বর্তন কর্মকর্তা কৃঞ্চ প্রসাদ মল্লিক জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবছর পানি বেড়েছে এই সময়ে। এতে করে কৃষকরা সামান্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
অপরদিকে, কাপ্তাই হ্রদে পানি ধরে রাখার দায়িত্বে থাকা কাপ্তাই পানি বিদ্যুত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমান ১০৮.৫৪ এমএসএল। ১৬টি স্পিলওয়ের মধ্যে মাত্র ৮টি দিয়ে প্রতিসেকেন্ডে ৪ হাজার পাঁচশো কিউসেক পানি ছাড়া হচ্ছে। পানি ধরে রাখার চেষ্টাও করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রটির উদ্বর্তন একজন কর্মকর্তা।
এদিকে অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে শহরে কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেষে গড়ে উঠা সরকারি বেসরকারি অনেকগুলো স্থাপনা বাড়ি-ঘর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। হ্রদের পানির সৃষ্ট ঢেউয়ে দু’পাশ ভেঙ্গে যেকোনা সময় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে জেলার একমাত্র শহর রক্ষা ফিসারী বাধ সড়কটি। ইতোমধ্যেই এই সড়কের দু’পাশের রাস্তার বেশ কয়েকটি স্থানে বড় ধরনের ফাটঁল দিয়ে পানিতে ভেঙ্গে পড়ছে।
শহরের একমাত্র ঝুলন্ত সেতুটি গত দুইমাস ধরেই ডুবে আছে পানির নীচে। এতে করে পর্যটনের একমাত্র ব্র্যান্ডখ্যাত এই সেতুটি দেখতে আসা পর্যটকরা হতাশ ফিরে যাওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। জেলায় পর্যটনের সাথে জড়িত কয়েক হাজার ছোট-বড় ও মাঝারি ব্যবসায়ি বিপুল পরিমান ক্ষতির মুখে পড়েছে।
গত ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধসে ভঙ্গুর হয়ে পাহাড়ের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার অন্যতম নিয়ামক পর্যটন সেক্টর হলেও কাপ্তাই হ্রদের পানি না কমানোয় পুরো রাঙামাটির অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুরের দিকেই ধাবিত হচ্ছে প্রতিদিন, এমনই মন্তব্য এখানকার ব্যবসায়ি নেতৃবৃন্দের।