॥ আনোয়ার আল হক ॥
”আমার ঘরে বাবা একটা ফুটা পয়সাও নাই’ এর ওর থেকে খুঁজে মেগে খাই, কখনও ভিক্ষা করি; আমি কেমনে ঋণ পরিশোদ করুম ? আমি জীবনে কখনও কোনো ঋণ লই নাই বা কোনো টাকাও কারো কাছ থাইক্কা গ্রহণ করি নাই, এখন হুনতাছি আমার নামে ৭০ হাজার টাকা ঋণ। বাবা, আপনারা এর বিচার কইরা দ্যান”। গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে এই কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন বয়সের ভারে ন্যুজ এক বৃদ্ধা; নাম জাবেদা বেগম। তার বয়স হয়তো ৬৫ হয় নাই, কিন্তু রোগে শোকে নেতিয়ে পড়া বৃদ্ধাকে দেখে মনে হলো তিনি আশির কোটা পেরিয়েছেন। সাংবাদিক যে তার বিচার করতে পারবে না, তিনি এটাও বোঝেন না।
বৃদ্ধার বলা দেখে হড়বড় করে নিজেদের মনের দুঃখ বলতে এগিয়ে এলো শত শত কৃষাণ কিষাণী। তাদের কারো নামে ৩৫, কারো নামে ৬৫ হাজার আবার কারো নামে ১ লক্ষ পাঁচ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাঠিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এই অন্যায়ের বিচার পেতে রোববার (১৪ জানুয়ারি) লংগদু সোনালী ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করেছে কয়েকশত ভূক্তভূগী মানুষ।
সবাই ধর্ম সাক্ষী রেখে, কেউ বা কসম কেটে গ্রামের ভাষায় যা বলার চেষ্টা করলেন তা হলো, এর মধ্যে ৯০ ভাগ মানুষ জীবনে কখনও কোনো ঋণই নেয়নি ব্যাংক থেকে। কেউ কেউ ঋণ নিলেও কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, সোনালী ব্যাংক থেকে নয়। কিন্তু ঋণ ছাড়ের একযুগ পর হঠাৎ করেই যেন ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুম ভেঙ্গেছে। তারা একযোগে নোটিশ পাঠিয়েছে পাঁচ শাতাধিক মানুষের কাছে। এখন কৃষকদের মাথায় হাত।
এভাবেই এসব গরীব কৃষকের মাথা বিক্রি করে সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখার অন্তত ৩০ কোটি টাকা লাপাত্তা করে দিয়ে দিয়েছে একটি দুষ্ট চক্র। এই চক্রে সোনালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা যেমন জড়িত, তেমনি ওই ব্যাংকের মাঝারী ও নি¤œবেতনভূক কর্মচারী থেকে শুরু করে এলাকার কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি এবং কয়েকজন টাউট শ্রেণির দালালও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
২০১০/১১ এবং ১২ সালে এসব ভূয়া ঋণ কৃষকদের নামে ছাড় করা হয়। তাদের কেউ স্বশরীরে ব্যাংকে না এলেও টাকাগুলো ঠিকই উত্তোলন বা ছাড় করা হয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতার বরাবরে সরাসরি বা তার ব্যাংক একাউন্ট ছাড়া ঋণের টাকা ছাড় করার কথা নয়। এ ধরণের ঋণ তিন বছরের মধ্যে পরিশোধ না হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের ঘুম হারাম করে দেবার কথা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ১২ বছরে কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও কাউকে জানায়নি এত বিপুল পরিমানের ঋণের টাকা কোথায় গেলো বা কেন কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করছে না। এই সময়ের মধ্যে কাউকে লিখিত বা মৌখিকভাবে একবারও জানানো হয়নি। এরই ফাঁকে চার/পাঁচজন ব্যবস্থাপক পার হয়ে গেছেন। যারা প্রত্যেই এখন কেউ দোতালা বাড়ির মালিক, কেউ চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে আয়েশি জীবন যাপন করছেন।
দরীদ্র মানুষ হলেও সবাই তো আর বোকা না। তারাই জানালো, যেসব এলাকায় সোনালী ব্যাংকের এসব ভূয়া ঋণ বিতরণের কথা বলা হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে সোনালী ব্যাংক থেকে সেখানে কোনো ক্ষুদ্র বা কৃষি ঋণ বিতরণের কথাই না। কারণ ভূক্তভুগীদের এলাকা ভাসাইন্যা আদাম এবং বগাত্তর ইউনিয়ন কৃষি ব্যাংকের আওতাভূক্ত। আবার যারা কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের পুণরায় ঋণ প্রদানের জন্য কৃষিব্যাংক থেকে কোনো অনাপত্তি বা ঋণমুক্তির কোনো সনদও গ্রহণ করা হয়নি।
ভুক্তভুগীরা জানালো তারা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাওয়ার পর খোঁজ খবর নিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার নাম জানতে পেরেছেন; যারা বিগত একযুগ এই ঋণের তথ্য গোপন করে গোটা ব্যাংকটিকেই জালজালিয়াতির পাল্লায় ফেলে দিয়েছে। এসব কর্মকর্তাদের কয়েকজন হলো আলোড়ন চাকমা, আব্দুস ছাত্তার, বিল্লু কুমার তনচঙ্গ্যা, পিন্টু চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, প্রফুল্ল কুমার দাশ, নবীন কান্তি চাকমা ও পূর্ণগীতি চাকমা।
এসব কর্মকর্তাদের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক আবুল হাসেম, কোনো তথ্যই দিতে রাজি হননি। তিনি ঋণের টাকা আদায়ে কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন বা কোনো তথ্য দিতে চান না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি রহস্যজনকভাবে জানান, তার উর্ধতন কর্মকর্তারা তাকে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। ব্যাংকের টাকা উদ্ধারে দোষীদের খুঁজে বের করতে সহযোগীতা করার বদলে কেন এই রাখ-ঢাক তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ভাসাইন্যা আদম ও বগাচত্তর ইউনিয়নের এসব গরীব মানুষকে সরকারি অনুদান দেওয়ার কথা বলে তাদের ভোটার আইডি কার্ড সংগ্রহ করে সাদা কাগজে বা ভূয়া কোনো কাগজে তাদের স্বাক্ষর ও টিপসই গ্রহণ করা হয়। কারো কাছ থেকে বাজারে, কারো কাছ থেকে রাস্তায় এসব স্বাক্ষর নেয় ব্যাংকের লোকজন এবং স্থানীয় নেতাগোছের বা টাউট শ্রেণির মানুষরা। অভাবি গ্রামবাসী সরল বিশ্বাসে সাহায্য পাবার আশায় তাদের আইডি কার্ড এবং স্বাক্ষর দেয়। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে এক হাজার টাকা করে দিয়ে আরো লোকজন ডেকে আনার কথা বলা হয়। তবে গুটিকয়েক ভূক্তভূগী এক হাজার টাকা করে পেলেও তাদের বেশির ভাগই কোনো টাকাই কখনও পাননি। বা তাদেরকে সোনালী ব্যাংকের ধারেকাছেও কখনও নিয়ে যাওয়া হয়নি।
সোনালী ব্যাংকের ফিল্ড অফিসার, তৎকালীন ব্যবস্থাপক, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এবং তাদের চামচারা (মিষ্টি কালাম, হাতেম, জামাল, মজিদ মাষ্টার) পরস্পর যোগ সাজশে এসব আইডি কার্ডের পিছন দিক বদলিয়ে লংগদু ও মাইনী ইউনিয়নের ঠিকানা বসায় এবং সেখান থেকেই তাদের নামে নাগরিক সনদ নিয়ে ঋণ প্রস্তাব করে।
কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই প্রক্রিয়ায় কারো কারো নামে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চারটি পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০৭ জনের নামে একটি করে, ৩০ জনের নামে ২টি করে, ৪ জনের নামে ৩টি করে এবং ৩ জনের নামে ৪টি করে ক্ষুদ্রঋণ প্রস্তাবের তালিকা পাওয়া গেছে, আরো ভূক্তভুগী থাকতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। যা সুদে আসলে এখন ৩০ কোটি টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন এক ভুক্তভুগীর স্বামী আইন উদ্দীন।
আইনউদ্দীন দৃঢ়তার সাথে জানায় আমরা জেল খাটবো তবুও এই টাকা পরিশোধ করবো না। যে টাকা আমরা ধরি নাই ছুঁই নাই, তার দায়ভার আমরা কেন নিবো ? ১২ বছর পর হঠাৎ করে আমাদের নামে নোটিশ করা হলো, কিন্তু ঋণের টাকা দেওয়ার সময় কোনো অফিসার একবারও তো আমাদের চেহারাও দেখতে চায়নি। তারা কিভাবে অজ্ঞাত ব্যক্তির টাকা অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে?
এ বিষয়ে মতামত জানতে লংগদু উজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি সে সময় সরকারি দায়িত্ব পালনে জেলা সদরে ছিলেন। তবে ভূক্তভূগীরা এর আগে ইউএনওর কাছে বিষয়টি জানানোর সাথে সাথেই তিনি সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাকের ডেকে সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানীর শিকার না হয়, সে লক্ষ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
লংগদু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার বলেন, আমি গরীব গ্রামবাসীর কাছ থেকে ঘটনা অবহিত হবার পরপরই উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় বিষয়টি উত্থাপন করি এবং প্রকৃত দায়ীদের খুঁজে বের করা পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে হয়রানী না করার অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি বলেন, সাধারণ গ্রামবাসী প্রতারিত হয়েছে। তাদের বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় দেখা উচিৎ এবং প্রকৃত দায়ীদের খুঁজে বের করা উচিৎ।