॥ রাঙামাটি রিপোর্ট ॥ চতূর্থবারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলটির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। ২৯৯ নং পার্বত্য রাঙামাটি সংসদীয় আসনের ২০৩টি ভোট কেন্দ্রের প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী তিনি নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লক্ষ ৫৯ হাজার ২৮৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেএসএস সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার সিংহ প্রতীকে পেয়েছেন ১ লক্ষ ৮ হাজার ৩৬ ভোট। তবে এই ফলাফল প্রতিবেদকের নিজস্ব সোর্স থেকে প্রাপ্ত; যা রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর থেকে এখনও ঘোষণা করা হয়নি। দীপংকর তালুকদারের এবারের বিজয় সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং বড় ব্যবধানের বিজয়। এই বিজয়কে অভূতপূর্ব বিজয় আখ্যায়িত করে দাদা দীপংকর তালুকদারের উপর আস্থা রেখে নৌকা মার্কায় বিপুল পরিমাণ ভোট প্রদান করায় রাঙামাটি জেলার সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। নির্ভরযোগ্য সুত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে ভোটের এই হিসাব পাওয়া গেছে। (রিটার্নিং কর্মকর্তার চুড়ান্ত হিসাবের সাথে এই হিসাবের তারতম্য হতে পারে)।
সোমবার (৩১ ডিসেম্বর) রাত ৯টায় রাঙামাটি জেলাপ্রশাসক ও রির্টানিং কর্মকর্তা একেএম মামুনুর রশিদ দৈনিক রাঙামাটিকে জানান, আজ মঙ্গলবার দুপুর ২টায় সর্বশেষ হেলিকপ্টারটি রাঙামাটি পৌঁছুবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর পরপরই বিকাল ৩টা নাগাদ এই আসনের চুড়ান্ত বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করা হবে। তবে সোমবার পর্যন্ত জেলার ২০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৯৭টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেছেন জেলা রিটানির্ং কর্মকর্তা। তাঁর ঘোষিত ফলাফলে ১৯৭ কেন্দ্রে দীপংকর তালুকদার পেয়েছেন ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭৮ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান এমপি ও জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী উষাতন তালুকদার সিংহ মার্কায় পান ১ লাখ ৫ হাজার ৮৪ ভোট। এছাড়া বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিস্বপন দেওয়ান ধানের শীষে পেয়েছেন ৩১ হাজার ২০১ ভোট, জাতীয় পার্টি সমর্থিত এডভোকেট পারভেজ তালুকদার লাঙ্গল মার্কায় পেয়েছেন ৪৮০ ভোট, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির জুই চাকমা কোদাল প্রতীকে ৪৭৬ ভোট এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী জসীম উদ্দিন হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ৫৫৪ ভোট।
এর আগে ভোটের দিন রোববার (৩০ ডিসেম্বর) রাত ১টা পর্যন্ত এই আসনের ২০৩টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে বেসরকারী ভাবে ১৮৪টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণ করার পর অবশিষ্ট ফলাফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে ঘোষণা করা হবে মর্মে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখেন রির্টার্নিং কর্মকর্তা। ওই রাতে সকল দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সহকারী রিটানিং অফিসার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম শফি কামাল এই বেসরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণা করেন। এ সময় ২৯৯নং রাঙামাটি আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, মহিলা সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু, অপর প্রার্থীদের প্রতিনিধি, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিনিধি কর্মকর্তা নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য দুর্গম রাঙামাটি জেলার ১৯টি ভোট কেন্দ্রে উপকরণ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ অন্যান্য লোকজন পৌঁছানো এবং আনার কাজে হেলিকপ্টার ব্যতিত অন্য কোনো উপায় নেই। দুর্গম এসব কেন্দ্রের ফলাফল পেতে সব সময়ই কিছুটা বেশী সময় লেগে যায়।
সরকারিভাবে বা বেসরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ থাকলেও ভোটের ব্যবধানের সাথে অপ্রাপ্ত কেন্দ্রসমূহের ভোটের পার্থক্য স্পষ্ট থাকায় রোববার রাতেই দীপংকর তালুকদারের বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় স্থানীয় জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মীরা। এরপর থেকেই বিভিন্ন স্তরের মানুষ দীপংকর তালুকদারকে অভিনন্দন জানাতে তার বাসভবনে ভিড় জমান। তিনিও একমাসের বিরামহীন ক্লান্তি ভুলে হাসিমুখে সবার সাথে কুশল বিনিময় করেন এবং মিষ্টি মুখ করেন। সোমবার এই নেতা দলীয় তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুশল বিনিময় ও মিষ্টি বিতরণ করে আসেন।
প্রসঙ্গত, এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের এই সাবেক নেতা ৪র্থ বারের মতো এমপি নির্বাচিত হলেন। এর আগে নৌকার টিকিটে ১৯৯১ সালে তিনি প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। সেবার সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। পরের নির্বাচন অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ সংসদটি ছিল ৪ মাসের সংসদ, সেবার আওয়ামী লীগ ভোট বর্জন করেছিল। তখন এমপি হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী প্রয়াত পারিজাত কুসুম চাকমা। একই বছর ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দীপংকর তালুকদার আবারও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। এই সংসদের মেয়াদকালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় শরনার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন তিনি। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদে তিনি হেরে যান প্রাক্তণ উপ-মন্ত্রী বিএনপি’র মণিস্বপন দেওয়ানের কাছে। ২০০৮ সালে নবম সংসদে আবারও নিজের আসন পুণরুদ্ধার করেন তিনি। এবার দল তাকে মূল্যায়ন করে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে তিনি আঞ্চলিক দলের উষাতন তালুকদারের কাছে হেরে যান। তার এই হার আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত হার ছিল বলেই পর্যবেক্ষক মহলের মূল্যায়ন ছিল। কারণ বিরোধী দল বিহীন এই নির্বাচনে সমগ্র মাঠ তার পক্ষে থাকলেও পরিচালনার দুর্বলতায় তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে বসেন। তবে সেই নির্বাচনে ১৫৩ কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠে। ১৪ সালের হারের পর গা ঝাড়া দিয়ে বসেন দীপংকর তালুকদার। এমপি না হয়েছে তিনি পাঁচ বছর তার নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়িয়েছেন প্রতিনিয়িত। দলীয় নেতাকর্মীরা দুরে থাক ভোটারদের থেকেও তিনি এক মূহুর্তের জন্যও নিজেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে দেননি।
অবশেষে সেই পরিশ্রমের কাক্সক্ষীত ফল হিসেবেই ২০১৮ সালের একাদশ সংসদে বিশাল আকারের জয় তার করতলগত হওয়াই প্রমাণ করে এই বর্ষিয়ান নেতা শুধু জাতীয় রাজনীতিতেই নন ভোটের রাজনীতিতেও অনেকের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিলেন বরাবরই।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফল হিসেবে পাহাড়ে উন্নয়নের জোয়ারে মাতৃজেলা রাঙামাটিতে গত পাঁচবছর এক ধরণের বন্ধাত্ব অনুভুব করেছে অভিভাবকহীন রাঙামাটিবাসী। এবার সে দুঃখ ঘুচিয়ে রাঙামাটি যাতে উন্নয়নের আলো জলমলিয়ে উঠে সেই আশায় রাঙামাটিবাসী শেখ হাসিনাকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমে দীপংকর তালুকদারের পূর্ণ মন্ত্রিত্ব কামনা করেছে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ক্যাম্পেইনই পরিচালনা করছে দলীয় সৈনিকেরা।
প্রসঙ্গত, দেশের বৃহত্তর এ জেলায় ১০ উপজেলা ও দুই পৌরসভা নিয়ে ভোটার হচ্ছে ৪ লাখ ১৮ হাজার ২৪৮ জন। এবারে রাঙামাটি জেলায় নতুন ভোটার ছিল ৩৯ হাজার ৫৬৩ জন। জেলার ১০ টি উপজেলায় ৫০ টি ইউনিয়নে ২০৩ টি ভোট কেন্দ্র ও ৮৯৩ টি বুথে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। জেলায় ৪ হাজারের বেশী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। রোববার (৩০ ডিসেম্বর) সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এবারের নির্বাচনে ৬জন প্রার্থীর মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী দীপংকর তালুকদার, বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী মনি স্বপণ দেওয়ান, জেএসএস সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার, জাতীয় পার্টির লাঙ্গলের প্রার্থী পারভেজ তালুকদার, বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির কোদালের প্রার্থী জুঁই চাকমা ও ইসলামী আন্দোলনের হাত পাখার প্রার্থী মোঃ জসিম উদ্দিন।