জাতির পিতার চিন্তার ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড

493

p..2

 

আনোয়ার আল হক- সম্পাদক দৈনিক রাঙামাটি, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ : পাহাড়, ছড়া, পাহাড়ি ঝর্ণা, জীব বৈচিত্র আর সবুজের সমারোহে ঘিরে থাকা শান্ত সুনিবিড় পার্বত্যাঞ্চলের কদর সেই আবহমান কাল থেকেই। সে কালের রাজন্যবর্গ এবং বৃটিশরা আদর করে পার্বত্য রাঙামাটির নাম দিয়েছিল কার্পাসমহল হিসেবে। কিন্তু শত শত বছর এ অঞ্চলের জন্য উন্নয়ন চিন্তা করেনি কেউ। দুর্গমতা, শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে যুগ যুগ ধরে উন্নয়নের ছোঁয়া বঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রাম- স্বাধীনতার মাত্র একদশক আগে সম্মুখীন হয় আরেক বিপর্যয়ের। এর নাম কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলেও এতে উদ্বাস্তু হয় লক্ষাধিক মানুষ। যুগ যুগান্তরে ঘাম ঝরানো; স্বাদের সংসার আর সঞ্চিত ধনরাশির পুরোটাই হারিয়ে যায় জলগর্ভে। দিশেহারা উদ্বস্তু মানুষ নিজেদের সামলে নিতে যখন প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আসে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক। দেশ স্বাধীন হলে প্রকৃতি ঘেরা নিজের প্রিয় ভূমিতে সফরে আসেন জাতির পিতা। পাহাড়ের মানুষের দৈন্যদশা স্বচক্ষে দেখে এই বিশাল হৃদয়ের মানুষটির প্রাণ যেন হুহু করে কেঁদে উঠে। আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করা সেই সিংহ পুরুষের উর্বর মস্তিস্ক থেকে বেরিয়ে আসে এক অভিনব চিন্তা; যার নাম আঞ্চলিক উন্নয়ন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই উর্বর চিন্তা থেকেই সৃষ্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয় বোর্ডের। যা দিনে দিনে পাহাড়ের মানুষের আশা আকাক্সক্ষার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।

১৯৭৩ সালের জুনে জাতির পিতার প্রথম ঘোষণা এক মাসের মাথায় পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য একটি পৃথক বোর্ড তৈরির ঘোষণা আসে সরকারিভাবে। সে ঘোষণাও দেওয়া হয় রাঙামাটিতেই। এই ধারাবহিকতায় ১৯৭৬ প্রতিষ্ঠা লাভ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের কেন্দ্রভূমি রাঙামাটিতেই পড়ে গড়ে উঠে এর সদর দপ্তর। প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে বান্দরবান এবং ১৯৮৩ সাথে খাগড়াছড়ি জেলা সৃষ্টি হলেও পার্বত্য অঞ্চলের তিন সার্কেলকেউ উন্নয়নের আওতায় রাখতে আর এই জেলা দু’টো বোর্ডের অধীনেই রাখা হয়।

৩৯ বছরে তিন পার্বত্য জেলায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির উন্নয়নে ১২শ’ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। পিছিয়ে পড়া পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা দেশের মুল ¯্রােতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার লক্ষ্য নিয়ে সৃষ্টি হওয়া উন্নয়ন বোর্ডের মিশন ও ভিশন হলো, দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পাহাড়ি জেলাগুলোর আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, নিরাপদ খাবার পানি, কৃষি উন্নয়ন ও সেচ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং দারিদ্র পরিবারের সদস্যদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, সর্বপোরী স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত করা ইত্যাদি। ‘মাত্র চার দশকের পথ চলায় এই বোর্ড এখন পার্বত্য উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে’ বলে মত প্রকাশ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তরুন কান্তি ঘোষ। তিনি জানান, উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে পরিচালিত সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পটি পাহাড়ে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা ও গ্রামীণ শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। এর মাধ্যমে ১ লক্ষ ৬০ হাজার শিশুর বিদ্যালয়মুখি হয়েছে। এই প্রকল্প দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের গৌরবময় ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ঘিরে আয়োজিত আগাম সংবাদ সম্মেলনে ভাইস চেয়ারম্যান আরো জানান, ৩৯ বছরে ১২’শ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ হাজার ৮১৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হলো, ৫ হাজার ৮৫০ মিটার সেচ নালা ও ১২২টি জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে ১২ হাজার ২২০ একর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান। ৩১৯টি মসজিদ, মন্দির ও প্যাগোড়া নির্ণাম ও সংস্কার। ১ হাজার ৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫০টি ছাত্রাবাস ও বিজ্ঞানাগার নির্মাণ ও সংস্কার। ৫৭টি বাজার শেড, ৫৯টি যৌথ খামার নির্মাণ ও ৩ হাজার ৩’শ পরিবারকে ০৪ একর করে ভূমি প্রদান। চিম্বুক, নীলাচল, মেঘলা, আলুটিলা, মাতাইপুখরীসহ বিভিন্ন স্থানে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণ। ৬১৫ কি.মি. রাস্তা, ৮১৪টি সেতু, ২ হাজার ৮৭১টি কালভার্ট ও ৫৪টি যাত্রী ছাউনী নির্মাণ। ৪টি ষ্টেডিয়াম, ১১টি অডিটোরিয়াম, ৩টি জিমনেসিয়াম ও ৯টি রেস্ট হাউজ নির্মাণ। ৪ হাজার পাড়া কেন্দ্র, ২২টি শিশু বান্ধব স্কুল প্রতিষ্ঠা ও ৪ টি আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালনা। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মেধাবী ও অস্বচ্ছল প্রায় ১৩ হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষা-বৃত্তি প্রদান। ২৩ হাজার ৮৩৫ একর জমিতে মিশ্র ফলের বাগান ও ১৩ হাজার ২’শ একর জমিতে রাবার বাগান সৃজন। এছাড়াও বর্তমানে প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুর্গম পার্বত্য এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপন ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার আইন সংশোধন করে উন্নয়ন বোর্ডের কাজে নতুন জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে এসেছে। আগামী দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকান্ড আরো গতিশীল হবে বলে প্রত্যাশা করেছেন পাহাড়ের বিদগ্ধ মানুষ।

সম্পাদনা- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরোপ্রধান