‘ডেড ল’ ঘোষিত পার্বত্য শাসনবিধি নিয়ে আকস্মিক তৎপরতায় পাহাড়ে উদ্বেগ

27

॥ বিশেষ প্রতিবেদন ॥

হাইকোর্টে ‘ডেড ল’ ঘোষিত পার্বত্য শাসনবিধি পুণরুজ্জীবীত করতে হঠাৎ করে একটি মহলের জোর তৎপরতায় পাহাড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা মনে করছেন, দেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার এবং অন্তবর্তী সরকারের উপর দেশি-বিদেশি নানামুখি চাপ সামলাতে যখন সরকার নাজুক পরিস্থিতিতে অবস্থান করছে, এমন একটি সময়ে পার্বত্য শাসনবিধি নিয়ে আদালত পাড়ায় আকস্মিক তৎপরতা পরিস্থিতিকে আরো উদ্বেগময় করে তোলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, বৃহস্পতিবার (২২ মে) আপিলেট ডিভিশনে এ সংক্রান্ত রিভিউ পিটিশন শুনানির তালিকায় আনতে গত কয়েকদিন যাবত জোর তদবির করছে পাহাড়ের একটি চিহ্নিত মহল।

যতদূর জানা গেছে, ২০১৮ সালে মহামান্য হাইকোর্টে ‘১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’ নামক রেগুলেশনটি ‘মৃত আইন’ ঘোষণা করে রায় দেয়ার পর, এ নিয়ে রিভিও পিটিশনটি দায়ের করা হয়। এরপর কয়েকটি শুনানী হলেও এক পর্যায়ে বিষয়টি কার্য তালিকায় না আসায় আর শুনানী হয়নি।

হঠৎ গত কয়েকদিন যাবৎ পাহাড়ে একটি খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে, বৃহস্পতিবার (২২ মে) ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি- ১৯০০’ সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য কার্যতালিকাভূক্ত হয়েছে।

একাধিক বাঙালি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সাংবাদিকদের ফোন করে বিষয়টি সত্য কিনা তা জানতে চাচ্ছেন। নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আদালত কর্তৃক বারবার ‘ডেড ল’ ঘোষিত এই রিভিও পিটিশনটি হঠাৎ করে কেন শুনানী তালিকায় আনতে মহলটি জোর তৎপরতা শুরু করেছে তা রহস্যময়।

ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যপকভাবে জনপ্রিয় একটি পোর্টালে খবর প্রকাশ করা হয়েছে যে, পাহাড়ের একটি মহণ সম্প্রতি ঢাকার বেইলি রোডে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদের নতুন রেস্ট হাউসে ঘন ঘন বৈঠক করছেন। গত ১২ মে এই রেস্ট হাউসে সুপ্রিম কোর্টের একজন উপজাতীয় আইনজীবীর সাথে তারা বৈঠক করেছেন।

সংবাদে উল্লখ করা হয়, রিভিও পিটিশনটি শুনানীতে আনতে কয়েকজন শীর্ষ পাহাড়ি নেতা ঢাকায় জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। তাদের সাথে বিষয়টি তদারকি করছেন সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কসহ কয়েকজন উপজাতীয় আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের একটি গ্রুপ এবং বামপন্থী কিছু নেতা।

তারা ঢাকা ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে কাজে লাগিয়েছেন। পাশাপাশি তাদের সাথে একজন সার্কেল চিফও মামলাটি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দেন দরবার করছেন।

ওই টিমটিকে ইতোমধ্যে অন্তবর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার অফিস ও বাসভবনে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রভাবশালী মহলের সাথে বেশ ঘনিষ্টভাবে যোগাযোগ করতে দেখা গেছে।

প্রসঙ্গত, রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ও ওয়াগ্গাছড়া এস্টেট লিমিটেড নামের ২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা পৃথক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কয়েক বছর আগে ‘১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’ কে ‘মৃত আইন’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

এতে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজমান বিভিন্ন আইন এবং দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু বিষয়ে পাহাড়ে স্বস্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কারণ বৃটিশ আমলে বিশেষ প্রেক্ষপটে ইংরেজরা তাদের শাসনকে সহজ করার জন্য পার্বত্য শাসনবিধি চালু করেছিল। বৃটিশদের কাছে দেশের মানুষের স্বার্থের যেমন কোনো মূল্য ছিল না, তেমনি এমন একটি বিশেষ আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে তাদের শাসিত অঞ্চলের অবশিষ্ট ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কোনো অসুবিধা হবে কিনা তাও বিচেনার মধ্যে ছিল না।

তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দূরে থেকে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল শাসন করে কিভাবে নিজেদের পকেট ভারি করা যায়। বৃটিশদের মধ্যে যেমন দেশ চিন্তার লেশমাত্র ছিল না। তেমনি দেশের মধ্যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কিনা তাও বিবেচনার গরজ ছিল না। আক্ষরিক অর্থে তখন কোনো দেশও ছিল না। পাক-ভারত উপমহাদেশের যে অঞ্চলগুলো তারা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দখল করে নিতে পেরেছিল। প্রতিটি অঞ্চলকে সাময়িক কালাকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ করে তারা শাসন করতো। ্এই ভাবে উপমহাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত তারা এমন সব আইন চাপিয়ে দিয়েছিল, যা কালের বিবর্তনে কালাকানুন হিসেবে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। পার্বত্য শাসন বিধি এই ধারাবাহিকতারই একটি অংশ।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিশেষ অঞ্চল নামে আখ্যা দিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বা সিএইচটি রেগুলেশন (চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট ম্যানুয়েল ১৯০০) নামক আইনটি ১৯০০ সালের ১ মে থেকে কার্যকর করে। এতে পার্বত্যাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন মূলত অকার্যকর হয়ে পড়ে। দেশ বিভাগের পর এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশের দায়িত্বে আসা দন্ডমূন্ডের কর্তারা বারবার অনুভব করেন যে অনেকাংশে এ আইন দেশের সাংবিধানিক বিধিবিধানের সাথে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক।

যে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রম নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই নানা টানাপোড় তৈরী হয় এবং রক্ত দিয়ে অর্জন করা একটি স্বাধীন ভূ-খন্ডের কোনো একটি অংশে বিশেষ শাসন বিবেকবান মানুষকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে শাসক এবং নাগরিকদের মাঝে মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয়। পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে বারুদের গন্ধ।

দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় এমন দ্বন্দ্ব চলার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও চুক্তির আড়াই দশকের ঘটনা পরিক্রমা প্রমাণ করেছে যে, দেশি বিদেশি য়ড়যন্ত্রের কারণে পাহাড়ের কাক্সক্ষীত সেই শান্তি আজও অধরা থেকে গেছে। পাহাড়ের মানুষের ধারণা, পাহাড় অশান্ত করে রাখার মূল হাতিয়ার হিসেবে বারবার পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিটিই ব্যবহার করা হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে রাঙামাটি ফুডস প্রোডাক্ট লি. এর এক মামলায় হাইকোর্ট বেঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি কে ‘ডেড ল’ বা অকার্যকর আইন বলে রায় দেয়। সংবিধানের বিভিন্ন ধারার সাথে সংঘর্ষিক ব্রিটিশ প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে ‘ডেড ল’ আখ্যা দেওয়া এই রায় ইতোমধ্যে ডিএলআরভূক্ত হয়েছে। সেই সময়ই অবশ্য রায়ের বিরুদ্ধে রিভেউ পিটিশন দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ।

পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে পৃথক দুই মামলার রায় দেয় সুপ্রীম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। ২০১৬ সালে ২২ নভেম্বর পুণরায় পার্বত্য শাসনবিধিকে একটি কার্যকর ও বৈধ আইন বলে রায় দেয় আদালত। অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্টে বিচারধীন ওয়াগ্গা ছড়া টি স্টেট এর অপর এক মামলায় ২০১৪ সালের ০২ ডিসেম্বর এই শাসনবিধির পক্ষে রায় দেয়া হয়।

এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ আখন্দ ও আব্দুল মালেক নামে দুই ব্যক্তি বাঙালিদের পক্ষে সুপ্রীম কোর্টে রিভিউ আবেদন দায়ের করেন। একাধিক শুনানির পর উচ্চ আদালত আগের রায় বাতিল করে ‘চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট ম্যানুয়েল- ১৯০০’ কে ডেড ল হিসেবে রায় দেয়। পাহাড়ের মানুষ মনে করে ঐতিহাসিক সেই রায়টি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে মজবুত করে।  কিন্তু সেই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিও পিটিশন হলে বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারেই থেকে যায়।

একাধিক সূত্র দাবি করেছে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি” শাসনবিধি চালু রাখতে ইতোমধ্যে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে দেশ বিরোধী একটি কুচক্রী মহল। ইতোমধ্যে তারা কয়েকটি মানববন্ধনও করেছে।

মহলটি পার্বত্য শাসনবিধি বহাল রাখার ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের সংবিধানের আওতার বাহিরে নিয়ে পরিচালিত করতে চাচ্ছে। এর পিছনে যেমন বিদেশি শক্তির ইন্দন রয়েছে, তেমনি পাহাড়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখা কয়েকটি সংগঠনের প্রদান প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন।

পাহাড়ের বেশ কয়েকজন বাঙালি নেতা মত প্রকাম করেছেন যে,“১৯০০ সালের শাসনবিধি” বহাল রাখলে সংবিধানের বাহিরে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিচালিত হলে দেশের অখন্ডতা হুমকির মুখে পড়বে।

তাদের দবি, আদালত রায়টি যদি বলবৎ করে পাহাড়ে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা দিনদিন বৃদ্ধির পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে চাকমা ব্যতীত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষকে বিতাড়িত করার পথ প্রশস্ত হবে।

পাশাপাশি : সিএইচটি রেগুলেশন পুণরায় কার্যকারিতা পেলে পাহাড়ে সরকার ও বাঙালিদের ভূমি অধিকার দারুনভাবে খর্ব হওয়ার পাশাপাশি পার্বত্য চুক্তির ফলে দুই দশকে অর্জিত সাফল্যগুলো হুমকির মুকে পড়বে। তিন পার্বত্য জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম আরো সীমীত হয়ে পড়বে। আইনটি ডেড ল’ হিসেবে ঘোষিত থাকায় এখন হেডম্যান কারবারীরা বাঙালিদের সাথে দৃশ্যত যে সব সহযোগীতা করছেন তার বিপরীতে হেডম্যান, কার্বারী ও সার্কেল চীফরা অসীম ক্ষমতার অধিকারী হবে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আবারও প্রথাগত ভূমি অধিকার দাবি সামনে এনে সব ভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। সর্বপোরী পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র দলসমূহের উস্কানিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।