॥ মনু মার্মা ॥
পানির অপর নাম যদি জীবন হয়, সেই জীবন নিয়ে দারণ সঙ্কটে দিনাতিপাত করছে রাঙামাটি সদর উপজেলার সাপছড়ি যৌথ খামার এলাকার বাসিন্দারা। শহরের খুব কাছের বাসিন্দা হয়েও বছরের পর বছর তারা তীব্র পানির সঙ্কট নিয়ে জীবন যাপন করছেন।
সুপেয় পানি তো দূরের কথা তাদের নিত্য ব্যবহার্য্য পানিটুকুর সংস্থানও নেই। বর্ষাকালে যেমন তেমন, শুকনো মওসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে এই সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষই তাদের এই পানি সঙ্কট নিরসনে উদ্যোগ নেয় না।
এলাকাবাসী জানায়, বহু বছর আগে তারা যখন এই পাহাড়ি গ্রামে বসবাস শুরু করেছিল, তখন পানির এমন সঙ্কট ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে ছোট ছোট ঝিরি-ঝরনা, ছড়া-খালগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে তারা দিনে দিনে এমন দুর্বিসহ জীবনে পড়েছেন। এখন শুকনো মওসুমে তিন থেকে ৪শ’ ফুট নীচে গিয়ে পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়।
এলাকাবাসী জানায় তাদের পানির কষ্ট দেখে অন্তত দুই যুগ আগে স্থানীয় একটি এনজিও জিএফএস (গ্রাভিটি ফ্লো সিস্টেম) এর মাধ্যমে ৫টি হাউজে পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বর্তমানে পানির উৎস মরে যাওয়ায় ৫টির মধ্যে ৪টিই অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। এখন গোসলের পানিতো দূরের কথা পিপাসা মিটানোর পানিটুক্ওু পর্যাপ্ত পরিমাণে মিলছে না। এলাকায় একটি সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয় ও ইউনিসেফ’র বিদ্যালয় রয়েছে। যেখানে বিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালীন শিক্ষার্থীরা চরম পানির কষ্টে ভোগে। বছরের পর বছর এমন মানবেতর জীবন থেকে বাঁচতে তারা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষে দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে আসছেন, কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি।
যৌথ খাবার এলাকার গৃহিণী নন্দরানী চাকমা বলেন, শুস্ক মৌসুমে পানির জন্য খুবই কষ্ট হয়। পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে পাইপের মাধ্যমে যে পানি পাওয়া যায়, তা দিয়ে কোনো রকমে চলতে হয়। এক কলস পানি নেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
এলাকার আরেক গৃহিণী বলেন, শুস্ক মওসুমে পানির সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। এতো বড় একটা গ্রাম, কিন্তু পানি পাওয়ার জায়গা মাত্র একটি। আসবাব পত্র ধোয়া তো দুরের কথা নিয়মিত খাবারের পানি, গোসলের পানিও পাওয়া যায় না।
এলাকার কার্বারী রতন চাকমা বলেন, আমাদের এলাকায় পানির কষ্ট দীর্ঘদিনের, সারা বছরই আমাদেরকে কষ্টে থাকতে হয়। আমাদের দু:খ ঘোচানোর যেন কেউ নেই। আমরা চাই, আমাদের নেতারা আমাদের পানির কষ্ট দূর করতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু তারা আমাদের কষ্ট দেখেও, না দেখার ভান করে থাকে, তাই আমাদের আকুতি এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে চাই।
স্থানীয় আরেক মুরুব্বী কালাচক্কু চাকমা জানান, এই এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। স্কুল খোলা থাকলে কোমলমতী শিক্ষার্থীরা চরম কষ্টে বিদ্যালয় সময় পার করে। বিদ্যালয়ে তাদের টয়লেট ব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকে না। এমনকি তেষ্টাটুকুও মেটাতে পারে না এই শিশুগুলো।
স্থানীয় এক মুরুব্বী আক্ষেপ করে প্রশ্ন তোলেন, মরুভূমির মতো জায়গায়ও মানুষ আবহমান কাল থেকে পানির ব্যবস্থা করে আসছে। কিন্তু বিশাল কাপ্তাই হ্রদের পাশে বসবাস করেও আমরা পানি পাই না। আমাদের সরকার, আমাদের প্রশাসন, বা আমাদের নেতাদের চোখে কি আমরা মানুষ নই?
এলাকাবাসী জানায় বেশ কয়েক বছর আগে এখানে নলকূপ বসাতে গিয়ে গ্যাসের উৎস্য বের হয়। তারপর বন্ধ হয়ে যায় পানির সন্ধান। আরো অনেক জায়গা পড়ে আছে, সেগুলোতে পরীক্ষা করে কেন কূপ খনন করা যায় না আমাদের বোধগম্য নয়। এমনও দিন যায়, এই গরমের দিনেও মা বোনেরা সপ্তাহে একদিন গোসল করতে পারেন। এমন দূর্বিসহ জীবন থেকে বাঁচতে অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে চান, কিন্তু তাদের যাবার জায়গাই বা কোথায় ?
এ বিষয়ে রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া জানান, সমগ্র দেশের পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় আনার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আমরা ইন্ডিভিজ্যুয়াল ওয়াটার পয়েন্ট কমিউনিটি বেইস ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম এবং রুরাল পাইপ নেটওয়ার্ক সাপ্লাই স্কিমের কাজ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। এই প্রকল্পের আওতায় মধ্যে সাপছড়ি যৌথ খামার এলাকায়ও একটি রুরাল পাইপ নেটওয়ার্ক সাপ্লাই স্কিম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্প পরিচালক দপ্তরে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে, প্রকল্পটি অনুমোদন হলেই আমরা কাজটি বাস্তবায়ন করবো এবং ওই এলাকার পানির সমস্যা দূর করা যাবে বলে মনে করি।