॥ আলমগীর মানিক ॥
পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনের জন্য চাঁদা আদায়ে সহায়তা, প্রকাশ্য দিবালোকে নিজের অধীনস্থ কর্মচারিকে চড় মারা, আইন লঙ্গন করে গুচ্ছগ্রামের নীরিহদের জন্য বরাদ্দকৃত রেশন কার্ড অন্যের নামে বরাদ্দ করে দেওয়া, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে রাস্তাবিহীন স্থানে ব্রীজ স্থাপন, নূন্যতম লে-আউট না দিয়েও ব্রীজ নির্মাণ শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে উপজেলার আইনশৃঙ্খলার রেজুলেশনে মিথ্যা তথ্য দেওয়া, টি-আর, কাবিখা প্রকল্পের বিল প্রদানে প্রকল্প চেয়ারম্যান ইউপি মেম্বারদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত তথাকথিত অফিস খরছ আদায় করা, বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে উপস্থিত না থাকাসহ এক ইউপি মেম্বারকে নিজ অফিসে ষড়যন্ত্র করে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ এখন রাঙামাটির সর্বত্র চাউর হলেও এখনো পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই রয়েছেন দেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা বাঘাইছড়ির প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোঃ নুরুন্নবী সরকার।
এই কর্মকর্তা কর্তৃক হয়রানীর শিকার হয়ে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা সভায় ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে বক্তব্যের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। স্থানীয় জনসাধারনসহ প্রশাসনিক সূত্রগুলোর ব্যাপক ক্ষোভের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসায় পিআইও নুরুন্নবী সরকার তিনদিনের সরকারি ছুটি নিয়ে গেলেও গত মঙ্গলবার তার ছুটি শেষ হবার পরেও রোববার পর্যন্ত তিনি অফিসে যোগদান করেননি বলে নিশ্চিত করেছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। জেলার ত্রাণ অফিসের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, পিআইও নুরুন্নবী ছুটি নিয়ে নিজ অধিদপ্তরে তদবিরে গেছেন যাতে করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাঘাইছড়ি থেকে অন্যত্র বদলি অর্ডার জারির জন্য।
বাঘাইছড়ির একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে প্রকল্প চেয়ারম্যান স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বারগণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে বিল বাবদ চেক নিতে উপজেলা পিআইও অফিসে আসলে সর্বনিন্ম ১৫ পার্সেন্ট কমিশন দিয়ে উক্ত বিলের চেকগুলো বুঝে নিতে হয়। বিষয়টি নিয়ে সত্যতা যাচাই করতে ৩৩নং মারিশ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মানব জ্যোতি চাকমা, ৩৭নং আমতলি ইউপি’র চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী, ৩৬নং সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমাসহ একাধিক ইউপি মেম্বার এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিন্ন তথ্য দিয়ে পিআইও কর্তৃক হয়রানী হওয়ার সত্যতা প্রতিবেদকে নিশ্চিত করেছেন।
সাজেকের ইউপি মেম্বার হিরানন্দ ত্রিপুরা, ৩৫নং বঙ্গলতলী ইউপির ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার তরুন বিকাশ চাকমা জানান, পিআইও তার কাছ থেকে ১৫% ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার নীতিশ চাকমা জানান, তার ৭৫ হাজার টাকার বিল থেকে পিআইও ২৪ হাজার টাকা অফিস খরছ বাবদ কেটে রেখেছেন। ৩৩নং মারিশ্যা ইউনিয়নের ইউপি মেম্বার(৯নংওয়ার্ড) মোফাজ্জল হোসেন, ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার রিপেল চাকমা, আমতলি ইউপির শমসের আলী মেম্বার সকলেই প্রতিবেদকে জানিয়েছেন, তারা নিজেরাই ১৫ শতাংশ হারে চাঁদাদিয়ে পিআইও নুরুন্নবীর কাছ থেকে তাদের টিআর-কাবিখা প্রকল্পগুলোর চেক নিয়েছেন। এছাড়াও ৩২নং বাঘাইছড়ি ইউপি’র মেম্বার প্রিয় বিকাশ চাকমা ও জমির আলী মেম্বার তারাও জানিয়েছেন অফিস খরছ দিয়েই বিলের চেক নিতে হয়। ৩৪নং রূপকারি ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল হামিদ জানিয়েছেন, আমার কাছে নগদ অর্থ নাথাকায় আমি অনেক বুঝিয়ে পিআইও’র কাছ থেকে চেক বুঝে নিয়ে ব্যাংক থেকে সেটি ভাঙিয়ে পরে ১৫ পার্সেন্ট টাকা পিআইওকে দিয়েছি।
এদিকে, আমতলি ইউপি চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী জানান,তিনি বাধ্য হয়েই বাঘাইছড়ির জনৈক ব্যবসায়ি শাহালমের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা পিআইওকে পাঠাই। ব্যবসায়ি শাহালম প্রতিবেদকের মুঠোফোন কলে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এদিকে জনপ্রতিনিধিদের সকলেই জানিয়েছেন, পিআইও নুরন্নবী সরকার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলায় “অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী”র আওতায় ৪০দিনের মধ্যে ৩০দিনের মজুরি দিয়ে বাকি ১০দিনের মজুরির অর্থ নিজে রেখে দেন।
আমতলি ইউপি চেয়ারম্যান রাসেল অভিযোগ করে বলেন, গত ২২/০৯/২০২০ তারিখে বাঘাইছড়ি উপজেলায় অনুষ্ঠিত মাসিক সভায় পিআইও নুরুন্নবী সরকার তার দপ্তর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক আমতলীতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তিনটি ব্রীজ শতভাগ অগ্রগতি হয়েছে বলে তথ্য উপস্থাপন করলেও আমতলিতে মাত্র দুইটি ব্রীজ হয়েছে বাকি একটি ব্রীজের কোনো অস্থিত্বই নেই। এই ব্রীজের অর্থ পিআইও নিজেই আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন চেয়ারম্যান।
এদিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কাইয়ুম জানিয়েছেন, পিআইও নিয়মনীতি অনুসরন নাকরে গুচ্ছগ্রামের কিছু রেশন কার্ড অন্যত্র অন্যদের নামে বরাদ্ধ দিয়েছেন। এটানিয়ে স্থানীয় গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। হতদরিদ্র একজনের রেশন কার্ড বাতিল করে পিআইও নিজের বাসার কাজে মেয়ের নামে বরাদ্ধ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অন্য এক জনপ্রতিনিধি। গুচ্ছগ্রাম নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট্য নীতিমালা থাকলেও পিআইও সেটির একটি অক্ষরও অনুসরন করেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন আমতলী ইউপি চেয়ারম্যান।
এছাড়াও পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত উপজাতীয় আঞ্চলিকদলের জন্য পিআইও নিজেই চাঁদা কেটে রাখেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী এইদলগুলোর সাথে পিআইও’র একান্ত যোগাযোগ রয়েছে যারফলশ্রুতিতেই গত ২৪শে ফেব্রুয়ারী ইউপি মেম্বার সমর বিজয় চাকমাকে গুলি করে হত্যা করেছে সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। এমন অভিযোগ মাসিক সভায় উত্থাপন করে পিআইওর বিরুদ্ধে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন আমতলী ইউপি চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী।
ইউপি চেয়ারম্যানের এই ধরনের সরাসরি অভিযোগে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুর্দশন চাকমা। তিনি জানান, আমরা নিজেরা উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ইউএনও সহ সকলকে নিয়ে উক্ত বিষয়ে নিজস্বভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। শীগ্রই পিআইও’র উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নিকট পত্রের মাধ্যমে বিষয়গুলো জানানো হবে বলেও প্রতিবেদককে জানিয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান।
এদিকে বাঘাইছড়ির পিআইও নুরুন্নবী সরকারের এতো অপকর্মের বিরুদ্ধে জানতে চাইলে জেলার ত্রাণ কর্মকর্তা মোঃ রোকনুজ্জামান বলেন, আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। এছাড়া পিআইওদের উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষ হলো উপজেলার ইউএনওগণ। এসব অভিযোগের ব্যাপারে ইউএনও’র সাথে যোগাযোগের পরামর্শও দেন তিনি।
বাঘাইছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শরিফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পিআইও’র বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি; তারপরও মাসিক সভায় যেহেতু বিষয়গুলো উঠেছে; আমরা খতিয়ে দেখছি।
এসব অভিযোগ বিষয়ে পিআইও নুরুন্নবীর দুইটি মোবাইল নাম্বারে একাধিক কল দিয়ে রিসিভ না করলে তাকে মুঠোফোনে এসএমএস এর মাধ্যমেও উত্তর চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি কোনো প্রকার সাড়া দেননি।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, বহুল বিতর্কিত পিআইও নুরুন্নবী সরকার তার পূর্বের কর্মস্থল গাইবান্ধায় থাকাকালীন সময়েও একাধিক অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন বলে সম্প্রতি নিশ্চিত করেছে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। সেখানে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থেকে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে বদলী করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে পিআইও নুরুন্নবী সরকারের বিরুদ্ধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অধিদপ্তর তার অনিয়ম ও দুর্নীতি যাচাই বাছাইপূর্বক তার সকল অনিয়ম ও দুর্নীতি অসৎআচারণের অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় তাকে পিআইও থেকে পদঅবনতি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়েছে। এছাড়াও একই সংঙ্গে স্থায়ী ভাবে লঘুদন্ড হিসেবে তার বেতন গ্রেডের নিন্মতর ধাপে অবনতি করে দশম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতন প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন-১) উপসচিব লুৎফর নাহার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।