পারিবারিক সহিংসতার শেষ কোথায়?

189

প্রতিবেদনে : তাশফিয়া জারিন হক, দসিনা লাবনী তাসিন, তানভিন আফরিন, পারিশা রাব্বানী, ফারিয়া ইসলাম, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সাদিক ইবনে নাসির ও সুবর্ণ বড়ুয়া।

৪২তম ব্যাচ,আইন বিভাগ,প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চট্রগ্রাম

সভ্যতা ও যুগের ক্রমশ পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ যেমন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক দিয়ে উৎকর্ষতা সাধন করেছে ঠিক তেমনি তার সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠছে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশেও এ ক্ষেত্রে কোন বৈপরীত্য দেখা যাবে না এটিই স্বাভাবিক। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এই সমাজে যে নির্দিষ্ট সমস্যাটি আজ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে সেটি হল পারিবারিক সহিংসতা। পরিবার যেহুতু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একক কোন প্রতিষ্ঠান নয়, তাই সামাজিক এই সমস্যাগুলো পরিস্ফুটিত হয় পরিবারের চার দেয়ালের ভিতর। মরনব্যাধি ক্যান্সার যেমন মানবদেহকে ধিরে ধিরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, ঠিক এই পারিবারিক সমস্যাও মরনব্যাধি ক্যানসারের ন্যায় আজ আমাদের পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাকে করেছে আক্রান্ত।

পারিবারিক কলহ বা সহিংসতা বলতে কোন একটি নির্দিষ্ট পরিবারে বা বিবাহিত সম্পর্কের পর একসাথে বসবাসের মতো পরিবেশে সংগঠিত সহিংসতাকে বুঝানো হয়। আমাদের দেশে সংগঠিত হওয়া পারিবারিক সহিংসতার প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে যদি একে সংজ্ঞায়ন করতে হয় তবে পারিবারিক সহিংসতা বলতে বৈবাহিক সম্পর্কের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার যে কলহ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লিঙ্গের উপর যে নির্যাতন তাকেই পারিবারিক সহিংসতা বলা হয়ে থাকে। সাধারণত পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হওয়ার ক্ষেত্রে লিঙ্গ, বয়স, পদমর্যাদা, ব্যাতিরকে যে কেউ এটির স্বীকার হতে পারেন, তবে এই পাক-ভারত উপমহাদেশে পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হল নারী ও শিশু।  প্রথাগতভাবে আমাদের বিরাজমান সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্যমূলক মূল্যবোধ চর্চার কারণে নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী শিক্ষার ঘাটতি, নারীদের সামাজিক ও পারিবারিক অধিকার নিয়ে উদাসীনতা, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারী অধিকার সম্পর্কিত ধর্মীয় বিধানের অপব্যাক্ষাসহ ইত্যাদি কারনে নারীরা পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হয় বেশি। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়াও অর্থনৈতিক, সামাজিক ভাবে নানা বৈষম্যের দিক থেকে নারীরা আজ পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার। আমাদের দেশে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত “মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন” নামক একটি বেসরকারি সংস্থা করোনাকালে নারী ও শিশু সহিংসতার উপর একটি জরিপ পরিচালনা করে যাতে  দেখা যায় ২০২০ সালের মে মাসে দেশের ৫৩ টি জেলায় প্রায় ১৩,৪৯৪ জন নারী ও শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের হার বেড়েছে শতকরা ৩১ ভাগ। সহিংসতার শিকার বেশিরভাগ নারী তার স্বামী কতৃক  পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। এই জাতীয় জরিপ থেকে এটিই পরিলক্ষিত যে যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ সভ্যতার ব্যাপ্তি ঘটেছে দাবি করলেও এই তথাকথিত সভ্যতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

একটি সুসংগঠিত পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো দাড় করানোর ক্ষেত্রে এই পারিবারিক সহিংসতা আজ বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যাধি আজ একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের পেছনে অন্যতম অন্তরায়। পারিবারিক সহিংসতা রোধে, বিশেষত নারীর প্রতি বৈষম্য রোধ প্রকল্পে সরকার কতৃক “পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ জারি, সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগে নানাবিধ প্রকল্প জারি আছে। আমাদের বর্তমান প্রচলিত আইনের কার্যকারিতার ব্যাপারে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত সহকারী অধ্যাপক মেহের নিগার বলেন, “বর্তমানে পারিবারিক সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনটি প্রশংসনীয়, উল্লেখিত আইনে ব্যক্তি কতৃক সংগঠিত এমন কিছু আচরণকে সহিংসতা হিসেবে অবহিত করা হয়েছে যাকে পূর্বে স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গণ্য করা হতো। তবে সমস্যা হলো উক্ত সহিংসতামূলক আচরণসমূহকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। সেই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে ব্যক্তি আদালতের হুকুম না মানলেই কেবল সেটি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ দেশের সাময়িক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পারিবারিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এই আইনটি ব্যাক্তি কতৃক সংগঠিত কিছু আচরণকে সহিংসতা হিসেবে অবহিত করলেও তাকে অপরাধ বলে সংজ্ঞায়িত করেনি। যার ফলশ্রুতিতে সহিংসতার শিকার ব্যাক্তি সরাসরি আদালতের আশ্রয় নেওয়া থেকে অপরাগ থেকে যায়। দেশের অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডের শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেখানে কঠোর শাস্তি অপরাধ দমন করতে অনেকক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় সেদিক বিবেচনায় অপেক্ষাকিত দুর্বল আইন পারিবারিক সহিংসতা রোধে তেমন একটি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না বরং এটি সহিংসতা অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বর্তমানে আইন তৈরি করে, সামাজিক আন্দোলন, সংবাদপত্র, প্রতিবেদন, অনলাইন অ্যাক্টিভিটি সহ নানা উপায়ে এই সমস্যা রোধে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও কার্যকরী। তবে এসব উদ্যোগের সাথে সাথে  আমাদের পরিবার থেকেই পারিবারিক মূল্যবোধ,পারিবারিক শিক্ষা, শিষ্টাচার, শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা, আত্মিক পরিশুদ্ধতা এসবের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রত্যেকটি পরিবার নিয়েই যখন সমাজ গঠিত হয়, তখন সেই প্রতিটি পরিবারের থেকে আগত সুশিক্ষায় পারে একটি সমাজ থেকে পারিবারিক সহিংসতার মতো সামাজিক ব্যাধিকে দূর করে একটি সুশৃঙ্খল দেশ উপহার দিতে। আর এই সমস্যা সমাজ থেকে দূর করতে না পারলে দেশ ও সমাজ থেকে যাবে অন্ধকারের দুর্গতিতে নিমজ্জিত।