পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৪ বছর: চুক্তি বাস্তবায়নে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ভূমিকা

659
নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান এবং অস্ত্র সমর্পণের একটি ছবি। ছবি- সংগ্রহিত
নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান এবং অস্ত্র সমর্পণের একটি ছবি। ছবি- সংগ্রহিত
নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান এবং অস্ত্র সমর্পণের একটি ছবি। ছবি- সংগ্রহিত

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ঢাকা ব্যুরো অফিস, দৈনিক রাঙামাটি।
আর মাত্র দুই মাস পর ২ ডিসেম্বর ২০২১, পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৪ বছর পূর্ণ হবে। চুক্তিটি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ সরকারকে যারা সমর্থণ দিয়ে মাঠে ছিলেন তাদের মধ্যে নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের নেতৃত্বে নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ভূমিকা ছিলো উল্লেখ যোগ্য। ১৯৯৮ সালের ৯ জুন শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে বিএনপির লংমার্চে বাধা দিয়ে পরিকল্পিত নাসকতা প্রতিহত করে সরকারকে সহযোগিতা করে ছিলেন। এই নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছেন- শামীমুল আহসান

বিউটিফুল বাংলাদেশর পরিপুরক এবং দেশে বিকশিত টেকসই পর্যটনশিল্প উন্নয়নে সহায়ক রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। নিসর্গিক সৌন্দর্য্য এবং উপজাতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্রে দেশ-বিদেশের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এ তিনটি জেলার বিশেষ কদর রয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলে শান্তিচুক্তির আগে টানা ২০ বছর শান্তিচুক্তির পরে প্রায় ৮ বছর দেশের সৌন্দর্য্য প্রিয় ভ্রমণ পিপাশুরা সে সৌন্দর্য্য এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র উপভোগ করতে পারেননি। সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সম্প্রদায়কেও গুম, হত্যা, ধর্ষণসহ নানান রকম নির্যাতন-নিপিড়ন এবং বঞ্চনার স্বীকার হতে হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর করা হয় ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি। কিন্তু শান্তিচুক্তির পর বিএনপি-জামায়াত জোট বিদেশী ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে জাতির কাছে শান্তিচুক্তির কুফল হিসেবে স্বাধীনতা বিরোধী উপজাতীদের উচকে দেয়ার পাশপাশি সে সময় সভা-সমাবেশে বলা শুরু করেন যে, এই চুক্তির ফলে ফেনী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ভারতের দখলে চলে যাবে। এরপর ১০ ফেব্রæয়ারি ১৯৯৮ তারিখে, খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করেন। এতে বিচলিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের নেতিবাচক চিন্তা-চেতনায় জাতিকে প্রভাবিত করতে ১৯৯৮ সালের ৯ জুন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ঘোষণা মতে ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চের যাত্রা শুরু করে।

এদিকে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের নির্দেশে নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান তার নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কের সাইনবোর্ড মোড় থেকে শিমরাইল পর্যন্ত রাস্তা দখল করে নেয়। সরকারের কাছে গেয়েন্দা সংস্থার তথ্য ছিলো সরকারকে ব্যার্থ করতে শান্তিচুক্তিকে উদ্দেশ্য করে লংমার্চ কর্মসূচি দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট। লংমার্চটি ফেনি পর্যন্ত পৌঁলে জঙ্গী-সন্ত্রাসী হামলা করিয়ে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটানোর পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো তাদের। এ তথ্যের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের নির্দেশেই শামীম ওসমানের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালের ৯ জুন বিএনপির লংমার্চ কর্মসূচির প্রতিবাদে নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচি পালন করেন। লংমার্চ প্রতিরোধে নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মীরা অংশগ্রহন করেন। লংমার্চ ঠেকাতে আগের দিন ৮ জুন রাত ৮টার পর থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকায় অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। তাদের মধ্যে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে সদ্য যোগদান কৃত নূর হোসেন ও হাবিবুল্লা কাঁচপুরির ভূমিকা নিয়ে বিএনপি সমর্থিত মিডিয়াগুলোর সমালো না ছিলো বেশী। ৯ জুন সকাল থেকে রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও, আড়াইহাজার, বন্দর, ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে দলে দলে এসে নেতা-কর্মীরা একত্রিত হয় শামীম ওসমানের নেতৃত্বে। শিমরাইল মোড়ে ১টি ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শান্তিচুক্তির সুফল বর্ণনা করে লংমার্চ কর্মসূচির বিরদ্ধে বক্তব্য দেন। এসময় সাইনবোর্ড এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে দফায় দফায় লংমার্চে আগত বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের সাথে ধাওায়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। দুপুরে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সদস্যসহ নেতা-কর্মীরা খাওয়া দাওয়া করেন হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরীর বাড়িতে।

এঘটনায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সূত্র ধরে সে সময় পিন্ট মিডিয়ায় শামীম ওসমানকে নারায়নগঞ্জের গডফাদার আখ্যা দেয় হয়। শামীম ওসমানের নেতৃত্বে ওই দিন নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগের কর্মসূচির ফলে লংমার্চ কর্মসূচির উপর জঙ্গীগোষ্ঠির যে নাসকতা হামলার পরিকল্পনা ছিলো তা থেকে তারা সরে আসে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এমন তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিন (৯ জুন) রাত ৮টার দিকে নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে। ওই রাতে সাইনবোর্ড সড়কে অবন্থান করে এর পরের দিন সকালে পুলিশের সহায়তায় বিএনপির লংমার্চ কর্মসূচির খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সমাবেশের মধ্যদিয়ে শেষ করা হয়।

বিভিন সময় সভা-সমাবেশে শামীম ওসমান তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমি শান্তিচুক্তির পক্ষে থেকে খালেদা জিয়ার লংমার্চ ঠেকিয়ে গডফাদার হয়েছি। অথচ লংমার্চের আগে আমার নামে কোন অভিযোগ ছিল না।’ ২০১৮ সেিলর ৭ এপ্রিল রাতে সিঙ্গাপুর আওয়ামী লীগের আয়োজনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানকে দেয়া এক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, চট্টগ্রামে লংমার্চের সেই বহরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকাসহ বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই ছিলেন না। খালেদা জিয়া জানতেন কিনা জানি না। তবে ওই লংমার্চে দুটি বাসে ৬৫ জন মাটিকাটার শ্রমিক ছিল যাদের ভাড়া করা হয়েছিল। টার্গেট ছিল জয়নাল হাজারীর ফেনীকে। ওই সময়ে আমি তাদের টার্গেটে ছিলাম না। টার্গেট ও পরিকল্পনা ছিল খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে বোমাহামলা হবে। আর শ্রমিকদের বহন করা ওই দুটি বাসে বোমা হামলা হবে। এতে ৬৫ জন মারা যাবে। আমি কিন্তু খালেদা জিয়ার লংমার্চ আটকে দেইনি। তিনি কিন্তু লংমার্চে গিয়েছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থার সংবাদের ভিত্তিতে দলের হাই কমানোডর নির্দেশে আমি জনগণকে সাথে নিয়ে গাড়িবহর আটকে সময় ক্ষেপণ করেছিলাম। সময় ক্ষেপণের কারণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিরাপত্তা জোরদার করেতে সক্ষম হয়েছিল।

চুক্তি সম্পাদন অনুষ্ঠানের একটি ছবি। ছবি- সংগ্রহিত
চুক্তি সম্পাদন অনুষ্ঠানের একটি ছবি। ছবি- সংগ্রহিত

পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির ফলে ঢাকার সাথে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তাতে করে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে শান্তিচুক্তির বিষয়ে একটা বার্তা পৌছে যায়। বার্তাটি হলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি মূলত: একটি রাজনৈতিক সমাধারে উম্মুক্ত পথ। যে কারণে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার শান্তিচুক্তি বাতিল বা এর বিকল্প সমাধান না দিয়ে বরং শান্তিচুক্তির ফায়দা লুটেছেন।

ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার শামীম ওসমানসহ নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও তার অংগ সংগঠনের ৭৯জন নেতা-কর্মীকে আসামী করে সিদ্দিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করে। ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর এ মামলাটি করেন বিএনপি নেতা আলাউদ্দিন আল আজাদ। মামলা নং-৪, তাং-০৫/১২/২০০১, ধারা-১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩৪২/৩২৩/৩৭৯/৪২৭/৩০৭/১১৪ দন্ডবিধি। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ধারা দীর্ঘ তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই নুরুল ইসলাম ৩০ নভেম্বর ২০০২ তারিখে ৫৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ২টি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্র নং-২৯৭ ও ২৯৭ (ক)। তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারভুক্ত আসামীদের মধ্যে ২২ জনকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দেয়। মামলায় ১১ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে পুলিশ। চার্জশীটভুক্ত আসামীদের মধ্যে আদমজীর রেহান উদ্দিন রেহান ও সিদ্দরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সম্পাদক আলী হোসেন মেম্বার মৃত্যুবরণ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় ওই সময় মামলা করেনি বিএনপি।

পূনরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগি সংগঠনের দশ নেতা আদালতে আত্মসমর্পন বরে জামিন প্রার্থনা করলে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদালতের বিচারক মো. জালালউদ্দিন প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা বন্ড প্রদান সাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর করেন। জামিনপ্রাপ্তরা হলেন, সাবেক (এ সময় ২০০৮’র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি) এমপি শামীম ওসমান, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নাজিমউদ্দিন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান ভূইয়া ও খালেদ হায়দার খান কাজল। এরপর হয়রানিমূলক মামলা হিসেবে আখ্যা দিয়ে আদালত মামলাটি খারিজ করে দেয়।

শামীমুল আহসান
ঢাকা ব্যুরো প্রধান- দৈনিক, রাঙামাটি