পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত

471

p-1
॥ আলমগীর মানিক ॥

অবশেষে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’র পূর্ণাঙ্গ বাংলা সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে। শনিবার রাঙামাটিতে জাঁকজমকপূর্ণ এক প্রকাশনা উৎসবের মধ্য দিয়ে এই গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক। একই সময় ‘দি চিটাগাং হিলট্যাক্টস রেগুলেশনের’ ইংরেজি ভার্সনটির দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশ করা হয়। এর আগে ২০১০ সালে ইংরেজি ভার্সনের ১ম সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছিল।

১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষায়িত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার এঅঞ্চলের জনগোষ্ঠির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন-১৯০০ নামে একটি বিশেষ শাসনবিধি চালু করে। এর পর ৪৭ এর দেশ বিভাগ এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পার্বত্যাঞ্চলের বিচার ব্যবস্থা বরাবরই এই শাসনবিধির অধীনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের জন্য ‘দি চিটাগাং হিলট্যাক্টস রেগুলেশন-১৯০০’ মূল আইন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিশেষ আইনটির বাংলা সংস্করণ না থাকাসহ এই আইন যথুপোযুক্তভাবে সংরক্ষণ না থাকার কারণে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে অসুবিধায় পড়েন এখানকার বিচারপ্রার্থী ও আইন সংশ্লিষ্টরা। আইনটি সম্পর্কে বিচারকার্য পরিচালনাকারী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও অধিবাসীদের মধ্যে সম্যক ধারনা প্রদানের লক্ষ্যে আইনটি গ্রন্থাকারে সম্পাদনা করা হয়, প্রকাশ করা হয়েছে বাংলা সংস্করণ।

এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) এর সার্বিক সহযোগিতায় এই গ্রন্থ দু’টি যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন চাকমা সার্কেলের চীফ ও সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবি ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় ও এডভোকেট প্রতিকার চাকমা।

শনিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত প্রকাশনা উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্টের বিভাগের বিচারপতি মোঃ রুহুল কুদ্দুস এবং হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা’র সভাপতিত্বে মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন, রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ কাওছার। বইটির সম্পাদক ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায় পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে এই আইন ও গন্থটির সার সংক্ষেপ তুলে ধরেন। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রাঙামাটি জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট প্রতিম রায় পাম্পু এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

রাঙামাটি জেলা আইনজীবী সমিতি ও এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) যৌথভাবে এই প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে রাঙামাটি জেলার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ খালেদ সাইফ উদ্দিন, বইটি অপর সম্পাদক এডভোকেট প্রতিকার চাকমা, রাঙামাটি বারের সাধারণ সম্পাদক তোষণ চাকমা, বারের প্রাক্তন সভাপতি এডভোকেট মোখতার আহম্মেদসহ রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ম্যজিস্ট্রেট এবং আইনজীবিগণ, গণমাধ্যমকর্মী, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন এডভোকেট লা থোয়াই ও এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা (পপি)।

প্রকাশনা উৎসবে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে আইনের যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে দেশের সব অঞ্চলের মানুষের জন্য তা খুবই উপকারে আসবে। বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সময়ে সময়ে প্রচলিত আইনসমূহের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সাংঘর্ষিক অবস্থাসমূহ নিয়ে গবেষণা পরিচালনার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, সময়ের বিবর্তনে মানুষ যুগোপযোগী হয়, আইনকেও সংশোধন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আইন ও বিচার প্রক্রিয়ায় সময়ে সময়ে অনেক ধরণের সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিষয় সুসংহতও হয়েছে।

তিনি আশা করেন সময় পরিক্রমায় ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলো দূরীভূত হয়ে যাবে। বিচারপতি ইতোমধ্যে পার্বত্যাঞ্চলের উদ্ভূত সমস্যার আরোকে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে উত্থাপিত বিচার প্রক্রিয়া এবং তার রায়সমূহ এক জায়গায় সন্নিবেশ করে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস তার বক্তব্যে বলেন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আইনকে সক্ষম এবং তাজা রাখার জন্য সময়ে সময়ে আইনকে যুগপোযোগী বা সংশোধন করতে হয়। তিনি বলেন, ‘অনগ্রসর অঞ্চল বা সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী’ আমরা যে আঙ্গিকেই ব্যখ্যা করি না কেন সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে আইনে যদি কোনো অসম্পূর্ণতা থাকে তা সংশোধন করতেই হবে। কারণ কোনো আইনই সমানভাবে সকলের অধিকার সংরক্ষণ করতে পারে না।

তবে একটি বিষয় আমার কাছে আজও পরিস্কার নয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালাটি কে প্রণয়ন করেছিলেন বা কোন কর্তৃপক্ষ প্রণয়ন করেন। ইতিহাসের প্রয়োজনেই এই প্রশ্নের উত্তর বের করা জরুরী।

সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, পার্বত্য আঞ্চলের যে বাস্তবতা এখানে সেনা শাসন, সেনা কর্তৃত্ব, গোয়েন্দা বাহিনীর যে অপতৎপরতা তা সীমাহীন। আমরা ৪৬ বছর ধরে এই সেনা শাসনের মধ্যে বসবাস করে আসছি।