॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥
রাঙামাটিতে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক বিষু, বিহু তথা বৈসাবী উৎসবের উদ্বোধনকালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান এমপি বলেছেন, আমরা পাহাড়ের বৈচিত্রময় ও বর্ণিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সৌন্দর্য বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে চাই। এ জন্য বিভিন্ন দেশের সাথে ইতোমধ্যে চুক্তি হয়েছে। এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে আমরা সবাই মিলে একসাথে কাজ করবো। তিনি মনমুগ্ধকর বৈসাবী অনুষ্ঠানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য আরও বৃদ্ধি পাবে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে মেলবন্ধন রচিত হবে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক বিষু. বিহু মেলা ২০২৪ এর উদ্বোধনকালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান এমপি এই মন্তব্য করেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এই বৈসাবি অহিংসার প্রতীক, বন্ধুত্বের প্রতীক এবং মৈত্রীর প্রতীক। পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধ হয় এতে পরষ্পরের মধ্যে বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়।”
তিনি বলেন পাহাড়ের ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্রময় ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য আমরা রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট অফিসের সাথে একটি মাল্টি ফাংশনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। যেখানে একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম থাকবে এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, পাহাড়ি জাতি গোষ্ঠীগুলোর যে সকল নাচ, গান, কবিতা, আবৃত্তি আর নাটক হারিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে এবং সংরক্ষণ করতে হবে।
বুধবার (৩ এপ্রিল) থেকে রাঙামাটিতে শুরু হয় চার দিনব্যাপী এই সংস্কৃতি মেলা। রাঙামাটি ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠিীর সাংস্কৃতিক ইন্সষ্টিটিউট প্রাঙ্গনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মেলার উদ্বোধন করেন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান (এমপি)।
এসময় বিশেষ অতিথি ছিলেন রাঙামাটি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার, সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সোহেল আহমেদ, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান ও পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ।
মেলায় রাঙামাটির চাকমা ,মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা ও গুর্খা, অহমিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ঐতিহ্যবাহি কারুকাজের হস্ত ও বস্ত্রশিল্প নিয়ে অংশ নিয়েছে । মেলায় বিভিন্ন ষ্টলে এ সব সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে। এর আগে শহরের কলেজ গেইট থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শুরু হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ইন্সটিটিউটে এসে শোভাযাত্রাটি শেষ হয়। শোভাযাত্রায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চংগ্যা, পাংখোয়া, অহমিয়াসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে অংশগ্রহণ করেন।
এই মেলার মধ্য দিয়ে রাঙামাটিতে নতুন বছরকে বরণ করতে মেলার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীগুলোর বৈসাবি উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। উদ্বোধনের পর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় সম্প্রীতি নৃত্য পরিবেশিত হয়।
পার্বত্য জনপদে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের উৎসব জাতিগোষ্ঠিগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে উদযাপন করে থাকে। উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে থাকে। এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। উৎসব হবে মূলত ১২, ১৩ ও ১৪ এপ্রিল। ১২ এপ্রিল ফুলবিজু, ১৩ এপ্রিল মূল বিজু বা খাওয়া-দাওয়া পর্ব এবং ১৪ এপ্রিল গইজ্যাপইজ্যা দিন বা বিশ্রামের দিন। উৎসবকে ঘিরে জেলায় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে পালিত হচ্ছে নানান কর্মসূচি। তারই অংশ হিসেবে শোভাযাত্রা, মেলা, ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, “বর্তমান সরকার সব সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠী উৎসব-পার্বণ যাতে নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে সেজন্য কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “পার্বত্য জেলা রাঙামাটি এখন আর পিছিয়ে পড়া জনপদ নয়। শিক্ষা-দীক্ষায় ও অবকাঠামো দিকে আমরা এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছি। বর্তমান সরকার এ পার্বত্য অঞ্চলের প্রতি খুবই আন্তরিক।”
রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, “এই মেলার মাধ্যমে আমাদের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যাতে আরও উন্নত হবে, সংরক্ষিত থাকবে। সবার মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা এই ধরনের অনুষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করছি। সম্প্রীতি ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে জেলা পরিষদ কাজ করে যাচ্ছে।”
মেলায় পাহাড়ের নারীদের হাতে ও তাঁতে বোনা কাপড়, ব্যাগসহ নানান হস্তশিল্পের অর্ধশতাধিক স্টল বসেছে। প্রথম দিন বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ছাড়াও সম্প্রীতি নৃত্য, বাঁশখড়ম দৌঁড় প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়।
চার দিনব্যাপী মেলায় ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলাধুলা, শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পিঠা উৎসব, বিভিন্ন জনজাতির ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র সঙ্গীত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঞ্চ নাটক, পাঁজন রান্না প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। ৬ এপ্রিল মেলা শেষ হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।