॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠির প্রধানতম সামাজিক উৎসব বৈসুক-সাংগ্রাই বিজু বিহু (যা বৈসাবি নামেই সমাধিক পরিচিত) উপলক্ষে ৫ দিনব্যাপি মেলা ও উৎসব শুরু হয়েছে। রাঙঙ্গামাটি জেলা পরিষদ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই উৎসব। মেলায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কাপড়-চোপড়সহ নানান সামগ্রীর স্টল বসানো হয়েছে। এছাড়া ৫দিনব্যাপী মেলায় ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলাধুলা, শিশু কিশোরদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, চাকমা নাটক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র সংগীত, উভগীত, গেংখুলী গীত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিঠা উৎসবসহ বিশিষ্টজনদের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠিত হবে।
রোববার (৪ এপ্রিল) বিকালে রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তন প্রাঙ্গনে যৌথভাবে বৈসাবি মেলার উদ্বোধন করেন, রাঙামাটিসংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি। রাঙামাটিপার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী’র সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ব্রিগেড কমান্ডার ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড ব্রি, জে, মোহাম্মদ ইমতাজ উদ্দিন, এনডিসি, পিএসসি, রাঙামাটিজেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন, রাঙামাটিপার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানগণ এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক গন এই সময় উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মেলা উদযাপন পরিষদের আহবায়ক রেমলিয়না পাংখোয়া।
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই উপলক্ষে মেলা স্থলে স্থাপিত বিভিন্ন স্টলে বিভিন্ন দ্রব্য ও অলঙ্কার এবং বস্ত্র প্রদর্শিত হচ্ছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাঙামাটি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিকে বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিষু-বিহু নামে পালন করে থাকে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রনে বৈসাবি এক বৈচিত্রময় রূপ ধারণ করেছে। এটা মূলত পুরোন বছরকে বিদায় দেওয়া আর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের এ বৈসাবি উৎসব। এই উৎসবটি বয়ে আনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন হয়। থাকেনা কোন হিংসা-বিদ্বেষ। আশা করি বৈসাবির আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্যদিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। পাহাড়ে বয়ে আসছে শান্তি ও সম্প্রীতি এক মিলন মেলা।
তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চল হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন। এই অঞ্চলের বহু ভাষাভাষি ও ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের পাহাড়ী বাঙ্গালী সকল সম্প্রদায় একটি সৌহাদ্য পূর্ণ অবস্থানে বসবাস করছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের সকল অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি সত্যার যে কৃষ্টি সংস্কৃতি, ভাষা, শব্দ বিলুপ্ত হতে চলেছে সেই সকল ভাষা, সংস্কৃতি গুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। এই সংরক্ষণ গুলো নিয়ে রাঙামাটিজেলা পরিষদ সহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক
ইনিস্টিটিউটগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু একটি গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই নির্দশনের উপর আঘাত হানতে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্য হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
দীপংকর তালূকদার বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের সম্প্রীতি নষ্ট করার পেছনে পাহাড়ের মুল কারণ হচ্ছে পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র। অবৈধ অস্ত্রধারীদের কারনে যে কোন সময় পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পার্বত্য অঞ্চলের দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর কারণে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ স্বস্থির নিশ^াস ফেলছে। তার পরও টহলরত সেনাবাহিনীর উপর গুলি করে ওয়ারেন্ট অফিসারকে হত্যা করার খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে দেশের সেনাবাহিনীসহ সকল জনগনকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
এর আগে রাঙামাটিজেলা পরিষদের উদ্যোগে বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা ও মেলার মধ্যদিয়ে বিজু সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু তথা বৈসাবী উৎসবের সূচনা হয়। রাঙামাটিসরকারি কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে একটি বর্ণাঢ্য আনন্দ র্যালিটি বের হয়ে র্যালিটি রাঙামাটিশহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মিলনায়তন প্রাঙ্গনে এসে শেষ হয়। সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনে ফিতা কেটে বেলুন ও পায়ড়া উড়িয়ে ৫দিনের মেলার উদ্বোধন করেন, দীপংকর তালুকদার এমপি। পরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এছাড়া সদুর সাজেক থেকে আসা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর গড়াইয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
এদিকে, পাহাড়ে প্রধান ও সামাজিক উৎসব বৈসাবী উৎসব পালন করা হচ্ছে এবার সারম্বরে। করোনা মহামারীর কারনে গত তিন বছরে বৈসাবি উৎসবের আয়োজন ছিল সীমিত পরিসরে। বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু, বিহু ও বাংলা নববর্ষ-২০২২ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে নানান অনুষ্ঠান মালার।
বৈসাবীর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এই দিনটিকে ঘিরে আনন্দ উৎসবে মেতে থাকে পাহাড়ের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। এবছর বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসার কারণে রাঙ্গামাটির সর্বত্র বৈসাবী উৎসব পালিত হবে আনন্দঘন পরিবেশে।
১২ এপ্রিল পাহাড়ের বৈসাবী উৎসবের প্রথম দিন চাকমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গ্যা জাতির ফুল বিজু বৈসু কিংবা বিষু। অনুরূপভাবে ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তির দিনকে বলা হয় মুল বিজ বৈসু বা বিষুু। আর ১৪ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলে মারমাদের জল কেলী উৎসব।
উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে সেই ফুল দিয়ে ঘর সাজায় ও মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে নদীতে ফুল ভাসায়। মুল বিজুর দিনে ঘরে ঘরে রান্না হয় ঐতিহ্যবাহী পাচন। আর বাংলা নববর্ষের দিনে রাঙ্গামাটির কাউখালীর বেতবুনিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে মারমাদের জলকেলী উৎসব।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটিতে বসবাসরত ১৩ নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে বিজু, সাংগ্রাইং, সাংক্রান, সাংক্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, জল উৎসব ও বাংলা নববর্ষ উৎসাহ উদ্দিপনার মধ্যদিয়ে পালন করা হয়। এ উৎসব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ৪ এপিল থেকে সংস্কৃতি মেলা ও র্যালিসহ বিভিন্ন ধরনের পাহাড়ি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৬ এপ্রিল মারমাদের জলকেলী উৎসব এর মধ্যদিয়ে বৈসাবী উৎসব শেষ হবে।