॥ আলমগীর মানিক ॥
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ২৮ সরকারি খাদ্যগুদামে সর্বশেষ শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে ছয় বছর আগে। যাদের নিয়োগচুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের ৩০ জুন। এরপর থেকে তিন মাস অন্তর সময় বাড়িয়ে কাজ দেওয়া হচ্ছে পূর্বের নিয়োগকৃত ঠিকাদারদের।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে ট্রাক প্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করছেন শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদাররা। এছাড়া নানান বিতর্ক ও অভিযোগ উঠে এসব ঠিকাদারর ওতাদের নিয়োগকৃত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে পরিবহন ঠিকাদারগণ খাদ্য অধিপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ছয় বছর পূর্বে নিয়োগকৃত বিতর্কিত এসব শ্রম ও হস্তার্পণ (হ্যান্ডেলিং) ঠিকাদারকে ফের ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ দুই অর্থ বছরের জন্য নিয়োগ দিতে তোড়জোর শুরু হয়েছে। এরমধ্যে রাঙামাটি ১১ খাদ্যগুদামের জন্য ১১টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রস্তুতকরে সুপারিশপত্রসহ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। একইভাবে খাগড়াছড়ির ১১ খাদ্যগুদামের জন্য শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদার চূড়ান্ত করা হয়েছে। তা অনুমোদনের জন্য সুপারিশপত্রসহ আগামী ককয়েকদিনের মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে পাঠানো হবে।
বান্দরবানে ৭ খাদ্যগুদামের ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহবান করা হয়েছে গত ২৬ জুলাই। র্নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায় এক হাজার দরপত্র বিক্রি হলেও প্রতিযোগিতামূলক এ টেন্ডারে কারা দরপত্র জমা দিয়েছেন তার আর জানা যায়নি। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের তালিকা নিয়ে চলছে ইঁদুর বিড়ালের লুকোচুরি। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরও উপর থেকে মানা আছে এই বিষয়ে কথা বলার। যদিও টেন্ডারে অংশগ্রহনকারী ঠিকাদার বা তাদের প্রতিনিধিদের সামনে ২২ আগস্ট বিকালে টেন্ডারবক্স খোলা হবে বিজ্ঞপ্তিতে উলে¬খ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বান্দরবান খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, রাঙামাটির ১১ এলএসডির (স্থানীয় খাদ্যগুদাম) কাজ ভাগিয়ে নেওয়া ঠিকাদার সিন্ডিকেটই বান্দরবানের কাজ ভাগিয়েছেন। তা কৌশলগত কারণে এখন প্রকাশ করা হচ্ছে না। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের পক্ষ থেকেও এই নিয়ে কারো সাথে কথা বলায় নিষেধ রয়েছে।
জানাগেছে, খাদ্য বিভাগের অনিয়ম দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির চিত্র তুলে ধরে গত ২৬ অক্টোবর খাদ্যের মহাপরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন খাদ্যবিভাগের সংক্ষুব্ধ ঠিকাদাররা।
খাদ্য উঠানো-নামানো কাজের জন্য সরকারের কোষাগার থেকে বিল পাওয়ার পর পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে তুলছেন শ্রম হস্তার্পণ ঠিকাদাররা। আর এই চাঁদাবাজিতে সহযোগিতা করছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সংশি¬ষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ। খাদ্যের ডিজিও দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখা এ অভিযোগে এই বিষয়ে প্রতিকার চেয়েছেন তারা।
সংশি¬ষ্টরা জানান, খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়মানুসারে প্রতি দুইবছর অন্তুর সরকারি খাদ্যগুদামগুলোতে খাদ্যপন্য উঠানো-নামানো কাজে (শ্রম ও হস্তার্পণ) ঠিকাদার নিয়োগ করার কথা। তবে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা ২৮ খাদ্যগুদামে সর্বশেষ শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে। যাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের ৩০ জুন। এরপর থেকে সংশি¬ষ্ট জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকগণ গোপন আঁতাতে তিনমাস অন্তর নিয়োগের (চুক্তির) মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ দিয়ে যাচ্ছেন।
মেসার্স তানজিনা এন্ট্রারপ্রাইজের মালিক আব্দুল আলম জানান, দীর্ঘ ছয়বছর পর খাগড়াছড়ির ১১ খাদ্যগুদামে শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদার নিয়োগে গত সেপ্টেম্বরে দরপত্র আহবান করেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়ার পর এ জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে এ কাজের ১ হাজার ৬৫টি দরপত্র বিক্রি হয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর দরপত্র দাখিলের শেষদিন দরপত্র সিডিউল জমা দিয়েছেন তিনশ’র বেশি ব্যবসায়িরা।
আব্দুল আলমের ভাষ্য, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি অনুযায়ি দরপত্রের মূল্য যাচাই করে সর্বনি¤œ দর প্রস্তাবকারীকে কাজ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে এখানে দরপত্রের মূল্য যাচাই ছাড়াই পুরোনো ১১ ঠিকাদারকে উচ্চমূল্যে কাজ দেওয়ার তোরজোড় চালিয়ে যাচ্ছেন জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক। এরসাথে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্যনিয়ন্ত্রকের দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছে বলে সংশি¬ষ্টরা জানান।
আপন ট্রেডার্সের মালিক ফজলে রাব্বী জানান, এরআগে রাঙামাটি জেলার ১০টি খাদ্যগুদামে শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সমঝোতায় (নেগোসিয়েশনে)। জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক কানিজ জাহান বিন্দু ইতোমধ্যে এসব ঠিকাদারের নাম প্রস্তুতকরে তা অনুমোদনের জন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে পাঠিয়েছেন।তিশা এন্ট্রারপ্রাইজের মালিক জীবন কৃষ্ণ সাহা জানান, বাজারদর যাচাই ছাড়াই উচ্চমূল্যে কাজ দেওয়ার কারণে শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদারদের পেছনে সরকারের কোষাগার থেকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ হবে।
অভিযোগ রয়েছে, রাঙামাটির এ শ্রম ও হস্তার্পণ ঠিকাদার নিয়োগে ১২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। যারভাগ খাদ্য বিভাগের জেলার সংশি¬ষ্ট কর্মকর্তার হাত বদল হয়ে অনুমোদন দেওয়া কর্মকর্তার টেকিলে পৌঁছার কথা উঠে এসেছে। রাঙামাটির এ লেনদেনের একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। সংঘবব্ধ একই সিন্ডিকেটকে বান্দরবানের কাজ দিতে ফাইলপত্র প্রস্তুতকরা হয়েছে বলে সংশি¬ষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, বান্দরবানে বর্তমানে তিন মাস অন্তর সময় বাড়িয়ে পুরোনো ঠিকাদারদের কাজ দিচ্ছেন জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক। একইভাবে কর্মকর্তা রাঙামাটি জেলার ১০ ও খাগড়াছড়ির ১১ খাদ্য গুদামেও তিন মাস অন্তর সময় বাড়িয়ে গোপনপত্রে কাজ দেওয়া হচ্ছে।
এই বিষয়ে রাঙামাটি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কানিজ জাহান বিন্দুর বক্তব্য জানতে চেয়ে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোনকরেও কোনো বক্তব্য মিলেনি।
খাগড়াছড়ি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়্যা নাজনীন বলেন, দরপত্র কার্যক্রম এখনও চলমান। কাউকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ (কাজ) দেওয়া হয়নি। দরপত্র মূল্যায়ন চলছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জহিরুল ইসলাম খানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোনকল করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়। পরে তাঁর হোয়াটাসঅ্যাপ নাম্বারে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি তা সিনকরলেও কোনো উত্তর দেননি।