॥ আলমগীর মানিক ॥
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বদলীকে কেন্দ্র করে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাঙামাটির সর্বত্র। পার্বত্য চুক্তির আলোকে জেলা পরিষদে অন্যান্য বিভাগগুলোর ন্যায় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগও জেলা পরিষদে ন্যাস্ত। জেলা পরিষদের কর্তৃত্বে আসার পর থেকেই প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ বা বদলি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক তদবীরের সকল কিছুরই নিয়ন্ত্রক হয়ে যায় জেলা পরিষদ। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষক। তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটির লংগদুতে। স্বেচ্ছায় বদলীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পছন্দের বিদ্যালয়ে বদলি করা হলেও যোগদান করেনি লংগদু উপজেলার চাইল্যাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
এদিকে বদলীর আদেশ প্রত্যাহার করে আগের বিদ্যালয়ে বহাল রাখতে ধারাবাহিক তদবির করছেন ওই শিক্ষকসহ তার পক্ষের জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক একটি মহল। মঞ্জুরুল হক নামের এই শিক্ষক তার ইচ্ছেনুসারে বদলির আদেশ পাওয়ার পর ৫৮ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও পদায়নকৃত দক্ষিন সোনাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অদ্যবদি যোগদান করেননি। এই সময়কালে উক্ত শিক্ষক তার বদলিপূর্বের কর্মস্থল চাইল্যাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তার কাছে থাকা গুরুত্বপূর্ন নথিপত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বুঝিয়ে দেননি। এতে উক্ত বিদ্যালয়ে বর্তমানে সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পাঠদান ব্যাহতের পাশাপাশি দাপ্তরিক কাজে অসুবিধা, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির পাসওয়ার্ড, ইউজার আইডি দিতে নাপারা, শিক্ষার্থীদের টিকাদানে বাধার সৃষ্টি, মাইকিং করতে বাধা দেওয়াসহ বিদ্যালয়ে সভা করতে পারছেনা বলে অভিযোগ করেছেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৩৮০জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
এদিকে উক্ত প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল হকের এহেন আচরণ চাকুরি বিধিমালার সরাসসি লঙ্গণ বলে মন্তব্য করেছে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। নিজের ইচ্ছেতেই বদলি হয়ে আবার সেই আদেশ অমান্য করে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে তদবীরে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে। এসব কিছুই উঠে এসেছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে।
উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উক্ত প্রধান শিক্ষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে তার প্রার্থিত বিদ্যালয়ে বদলির আদেশ প্রদান করা হয়। যার স্মারক নাম্বার-৩৮.০১.৮৪০০.০০০.০১১.০০৫-২২-৭৩৮, তারিখ: ১৬/০৮/২০২২। উক্ত আদেশে তাঁর বদলিজনিত চাইল্যাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শূন্যপদে মোঃ ফারুক হোসেন, প্রধান শিক্ষক, গুলশাখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লংগদু-কে তাঁর আবেদনক্রমে বদলি করা হয়। শিক্ষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৬ আগষ্টে জারিকৃত অফিস আদেশে স্পষ্টভাবে ৩নং শর্তে উল্লেখ করা হয়, ৩১শে আগষ্টের মধ্যে বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে অন্যথায় ৩১শে আগষ্ট ২০২২ থেকে কর্মবিমুক্ত বলে গণ্য করা হবে। কিন্তু শিক্ষক মঞ্জুরুল হক এই অফিস আদেশ অমান্য করে বিগত প্রায় ৫৮দিন নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছেন। এই বিষয়ে জানতে চাইলে লংগদু উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ইমাম উদ্দিন জানিয়েছেন, উক্ত শিক্ষক অনুপস্থিতির বিষয়টি আমি জেনেছি। তাই তার বেতন বন্ধ রাখা হয়েছে। তার ব্যাপারে উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি আমি। তিনি জানান, আমি শুনেনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে উক্ত শিক্ষক মঞ্জুরুল হক যোগাযোগ করেছেন, চেয়ারম্যাস স্যার যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিবো। এদিকে বিষয়টি নিয়ে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ সাজ্জাদ হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, স্পষ্টভাবেই উক্ত শিক্ষক চাকুরি বিধিমালা লঙ্গণ করছেন। তার নিজের ক্ষতি নিজেই করছেন। আমরা তার ব্যাপারে লিখিত একটি প্রতিবেদস জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয়কে প্রেরণ করেছি। সেই প্রতিবেদনে সবকিছুই উল্লেখ রয়েছে। সেখান থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তনুসারে শিক্ষক মঞ্জুরুল হকের ব্যাপারে বিধি অনুসারে সিদ্ধান্ত নিবো।
এদিকে রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসু প্রু চৌধুরীর কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, আমি বিষয়টি দেখছি। তিনি জানান, প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কারো কোনো অন্যায় আচরণ আমরা মেনে নেবোনা। ইতিমধ্যেই আমরা বর্গা শিক্ষক প্রথা থেকে শুরু করে ডেপুটেশন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বাতিল করে দিচ্ছি। লংগদুর শিক্ষকের ব্যাপারটি আমরা বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিবো।
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসকে নাকানি-চুবানি খাওয়ানো প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল হক এর কাছে উপরোক্ত অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, আমি নিজে থেকে কোনো বদলির আবেদন করিনি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রবিউল স্যার আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে একটি ফাইল তৈরি করেছেন। ইতিমধ্যেই আমার ব্যাপারটি নিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন যাতে করে আমাকে আমার পূর্বের কর্মস্থলে রাখা হয়।
অপরদিকে, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা রবিউল হোসেন এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমার সাথে উক্ত মঞ্জুরুলের কোনো ধরনের ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। তিনি জানান, উক্ত শিক্ষক মঞ্জুরুল হকের বিরুদ্ধে যদি আমি অফিসিয়ালী রিপোর্ট দিতাম তাহলে এতোদিনে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়ে যেতো।
এদিকে দূর্গম পাহাড়ে প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা থেকে উত্তরণে যখন সরকারের সংশ্লিষ্ট্য বিভাগগুলো নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেগুলো বাস্তবায়নে ধারাবাহিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এমতাবস্থায় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে এক শ্রেণীর শিক্ষকের যাচ্ছেতাই কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে যেমনিভাবে শিক্ষার বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হচেছ তেমনিভাবে শিক্ষা অফিসের নিজস্ব নীতিমালার ব্যতয় ঘটছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।