বঙ্গবন্ধুর শৈশব কৈশর ও ছাত্রজীবন

8986

shehk mujib

আনোয়ার আল হক- সম্পাদক, দনৈকি রাঙামাটি : ফাল্গুন মাসের দুপুর, শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক গৃহবধু, হাতের কাজ সেরে বাড়ির আমবাগানের ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন। সূর্য তখন মাথার উপর, সূর্যমামার শানদার উত্তাপেই যেন লজ্জা পেয়ে আমগাছের ছায়া কুঁকড়ে সংকুচিত হয়ে ঠিক গাছ বরাবর চলে এসেছে। ওই এক চিলতে ছায়ায় দাঁড়িয়ে মা তাকিয়ে আছেন দুর পথের দিকে। স্কুল ছুটির পর খোকা প্রতিদিন এই সময়ই আসে। সম্ভ্রান্ত বংশের বড় ছেলে, সবার আদরের দুলাল; চকিতে মা দেখলেন কে যেন হেটে আসছে। হাটার ধাচ বলে এ তারই খোকা। কিন্তু পুরো শরীর চাদর মুড়ি দেওয়া কেন? এগিয়ে গেলেন মা, এ যে খোকাই। কি হয়েছে বাবা? মায়ের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন। কই কিছু হয়নি তো! ছেলের ভাবলেশহীন উত্তর। তোমার জামা পায়জামা কই। ‘ও এই কথা? স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম একটি ছেলের গায়ে কোনো জামা কাপড় নেই। আমারই সমান; এই শীতে ওর কাটে কি করে বলোতো মা? তাই আমার জামা পায়জামা খুলে ওকে পরিয়ে দিয়ে এসেছি। ছেলেটা কি যে খুশী হয়েছে!’  মা একটু চিন্তিত হলেন ছেলের কান্ড দেখে। আবার পরক্ষণেই গর্বে বুক ফুলে উঠলো, কত উদার হয়েছে তার ছেলেটা। এই হলো বঙ্গবন্ধু। দশ বছর বয়সেই যিনি নিজের গায়ের কাপড় খুলে অন্যকে দান করে দিতে পেরেছিলেন।

মধুমতি আর ঘাগোর নদীর তীরে এবং হাওড়-বাঁওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা বাংলার অবারিত প্রাকৃতিক পরিবেশে টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি অবস্থিত, জেলার নাম ফরিদপুর। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে সারি সারি গাছগুলো ছিল ছবির মতো সাজানো। নদীতে তখন বড় বড় পালতোলা পানশি, কেরায়া নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। বর্ষায় গ্রামটিকে মনে হতো যেন শিল্পীর আঁকা জলে ডোবা একখন্ড ছবি। এই টুঙ্গিপাড়ারই একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এদিন শেখ লুত্ফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে চেহারার শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন খোকা। এই খোকাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জগৎ স্বীকৃত সমগ্র বাঙালির প্রিয় মানুষ। তিনি ছিলেন একজন মাতৃভক্ত সনত্মান। শৈশব-কৈশোরে বাবা-মা তাঁকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁদের তৃতীয় সন্তান। স্বভাবের দিক দিয়ে ছিলেন একটু জেদি, চঞ্চল ও একগুঁয়ে।

বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামন্ডিত এই টুঙ্গিপাড়াতেই। টুঙ্গীপাড়া গ্রামেই শেখ মুজিবুর রহমান ধন ধান্যে পুষ্প ভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ডুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। এভাবে তার শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন।

তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন। তাঁর মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হবেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার, পণ্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তাঁর পিতা বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি। পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক্ষক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব।

শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন-তেমনি কারও প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলেও প্রতিবাদ করতেন তিনি। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টানত্ম স্থাপন করেছিলেন তিনি। ওই সময় গোপালগঞ্জে স্বদেশী আন্দোলনের এক সমাবেশে জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ দেখে বিক্ষুব্ধ হন শিশু মুজিব। ফলে বিক্ষোভকারীরা যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয়, তখন তিনিও বন্ধুদের নিয়ে যোগ দেন বিক্ষোভকারীদের দলে। পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে তাঁরা নাজেহাল করে তোলেন পুলিশ সদস্যদের। তাঁর সাহস দেখে অবাক হন থানার বড় কর্তাও।

তাঁর বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি হঠাৎ চক্ষুরোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা চলে। কিন্তু অসুখ সারে না। এ কারণে তাঁর লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর পর আবার সুস্থ হয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। মনোযোগী হন লেখাপড়ায়। তখন ঘটে আরেক ঘটনা। গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর ব্যাপারে শহরের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিষয়টি কিশোর মুজিবের ভাল লাগেনি। তাই তিনি আয়োজকদের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন এবং দুর্জয় সাহস নিয়ে একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেন। সাহসী কিশোর মুজিব সেবার স্কুল ঘর মেরামত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার আদায় করেন। এসময় বিরোধীচক্রের রোষানলে পড়েন শেখ মুজিব। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। হাজতবাস করতে হয় সাতদিন। এটিই তাঁর জীবনের প্রথম কারাবরণ।

তৎকালীন সমাজের অনেকটা প্রথা হিসেবেই আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুন্ন রাখতে বঙ্গবন্ধু এগার বছর বয়সের সময় তার বিয়ে দেওয়া হয়। তখন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী রেণুর বয়স মাত্র তিন কি চার বছর। বিয়ের দু’বছর পর বঙ্গবন্ধুর শুশুর মারা গেলে তাঁর স্ত্রী তাদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে চলে আসেন এবং এখানেই লালিত পালিত হন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এ সময়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামী অধ্যায়। শৈশব থেকেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তাঁর গৃহ শিক্ষক। তাঁর এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান কর্মী। বাড়ি বাড়ি ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করেছেন। তিনি ফুটবল খেলেতে ভালোবাসতেন। স্কুল টিমের নেতা হয়ে বাবার টিমের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার জিতে যায় তার দল।

শৈশব থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজ জীবনের জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাঁকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্র্রতি অগাধ ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে সে যত বড়ই হোক, আত্মসমর্পন করেননি; মাথানত করেননি। টুঙ্গিপাড়ার সেই দুরনত্ম কিশোর শেখ মুজিবের নাম শুধু টুঙ্গিপাড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর নাম ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলায়, সারাবিশ্বে। পরিণত বয়সে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শোষিত-বঞ্চিত-গণমানুষের নেতা, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর সঠিক নেতৃত্ব এবং আহ্বানের কারণেই একাত্তরে বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপ দেয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। নিজস্ব একটি পতাকা ও একটি মানচিত্র নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পাই আমরা। তাঁর অশেষ অবদান এবং আত্মত্যাগের জন্যই তিনি আজ আমাদের কাছে জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, স্বাধীনতার মহান স্থপতি।

পোস্ট করেনন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরোপ্রধান ,  ১৬ মার্চ ২০১৬