মুক্তিযোদ্ধা, ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন আবু- ১৭ এপ্রিল ২০১৬, দৈনিক রাঙামাটি : স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম হয় ১৭ মার্চ, ১৯২০ বাংলা ১৩২৭ সালের ২০ চৈত্র মঙ্গলবার রাত আটটার সময় তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টঙ্গীপাড়া গ্রামে। শেখ মুজিব ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান, প্রথম পুত্র। বাড়ীতেই তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। গৃহ শিক্ষক ছিলেন পন্ডিত ছাকাওয়াতুল্লাহ। শেখ মুজিবের বাবা শেখ লুৎফর রহমান তখন মাদারীপুর দেওয়ানী আদালতের সেরেস্তাদার। তাই তিনি মাদারীপুরে চলে যান। সেখানে তাঁকে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ বর্ষে ভর্তি করে দেয়া হয়। ১৯৩৬ সালে জনাব লুৎফর রহমান মাদারীপুর থেকে গোপালগঞ্জে বদলী হন।
১৯৩৭ সালে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসেন এবং খৃষ্টানদের দ্বারা পরিচালিত ‘মিশন স্কুলের’ পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন একরোখা ও ডানপিঠে। ন্যায্য কথা বলতে তিনি কাউকে ছাড়তেন না, সেই জন্যে স্কুলের অন্যান্য ছাত্ররা তার অনুগত ছিল এবং সবাই তাকে মুজিব ভাই বলে ডাকতেন। শেখ লুৎফর রহমানের পারিবারিক অবস্থা ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল, সর্বসমেত একশ/দেড়শ বিঘার মত আবাদী জমি ছিল, তারপর চাকুরী। খেয়ে পরে বেশ চলত। শেখ মুজিবর রহমান এর পরিবারে পারিবারিক ও বাল্য বিবাহ প্রথা ছিল। শেখ মুজিব যখন বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৯ বছর এবং স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছার (রেনু) বয়স ছিল ৩ বছর। শশুর শেখ জহুরুল হক। শেখ মুজিব শৈশব থেকেই গরীবদের প্রতি উদার ও দানশীল ছিলেন। একবার দেশে ফসল ভাল হয়নি, লোকের অভাব অনটন। শেখ মুজিবের বাড়িতে গোলাভরা ধান, শেখ মুজিব গরিবদের মাঝে গোলা হতে ধান বিতরণ করলেন। তিনি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন একদিন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক আর খাদ্যমন্ত্রী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দু’জনে গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে করেন। তখন তিনি নির্বিঘেœ তাদের ডাক বাংলার পথ রোধ করে দাঁড়ান হোষ্টেলের ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা করার জন্য। ফজলুল হক বালকের সাহসে মুগ্ধ হয়ে তখনই তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে ১২০০ টাকা মঞ্জুর করে দেন। তাঁর সৎসাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হয়ে সোহরাওয়ার্দী মাঝে মাঝে ডাক বাংলো থেকে পিয়ন মারফত স্লিপ পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। তখন থেকেই সোহরাওয়ার্দী কিশোর মুজিবকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং শেরে বাংলা তাকে নাতি বলে ডাকতেন। সেই থেকে সোহরাওয়ার্দী হলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু যা শেখ মুজিব সবসময় স্বীকার করতেন। রাজনীতি করতে এসে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তাঁর প্রথম জেল হয়। ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জে মুসলমানরা এক অনুষ্ঠানে এক প্রদর্শনী খুলেন। সেখানে হিন্দু ও মুসলমান দাঙ্গা বাঁধলে শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপের ফলে মুসলমান নেতৃবৃন্দ রেহাই পান। ঘটনার কয়েক মাস পরে তিনি গ্রেফতার হন এবং তাঁর ৭ দিন জেল হয়। খেলাধুলার দিকেও তাঁর ঝোঁক কম ছিলনা। ১৯৪০ সালে তিনি ওয়ান্ডার্স ক্লাবের ফুটবলার ছিলেন। এ সময় কলকাতায় তিনি প্রয়াত জননেতা সামছুল হকের সান্নিধ্যে আসেন। শেখ মুজিব ১৯৪১ সালে টাংগাইলের মাইঠান-টেউরিয়া সামছুল হকের বাড়ীতে চলে আসেন, টেউরিয়া মাঠে ১ম একটি কর্মী মিটিং করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি পুনরায় সামছুল হকের বাড়ীতে আসেন এবং দক্ষিণ টাংগাইলের কর্মীদের সামনে ২য় বার টেউরিয়া মাঠে বক্তৃতা করেন। ১০/১২ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি ও চোখের সমস্যার কারণে ১৯৪২ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল হতে প্রবেশিকা (মেট্রিক) পাশ করেন।
এরপর তিনি কলকাতা গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। কলকাতা গমনের পূর্বেই তিনি ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের এবং অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন এবং গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু ছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিদের একজন। কলকাতা থাকাকালীন তিনি মাঝে মধ্যে রাজনীতি নিয়ে নেতাজী সুভাস বসুর সাথেও আলোচনা করতেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা সমিতিরও সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ডিসেম্বর মাসে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ এর বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া জেলায়। বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগে নাজিম উদ্দিন ও আকরাম খাঁ এবং অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক বাঙালী স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দূর্বার আন্দোলনে ছাত্র অংশের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিব। ১৯৪৫ সালে তৃতীয়বার সামছুল হকের ব্যবস্থাপনায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে দেলদুয়ার-এলাসিন মাঠে বিশাল জনসভায় মুজিব জীবনের প্রথম বক্তৃতা করেন। সামছুল হকের কাছে এভাবেই শেখ মুজিবের বক্তৃতার হাতে খড়ি। আর এভাবেই দু’জনের রাজনীতির পথে চলা। মূলতঃ ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সামছুল হক ও শেখ মুজিব ছিলেন গুরু-শিষ্যের মত। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময়ে তিনি পূর্ব বাংলা ও আসামের অবিসংবাদিত নেতা মাওলানা ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন এবং সিলেট জেলার গণভোটে মুসলিম লীগের বহু কর্মী নিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র থাকাকালীন তিনি থাকতেন বেকার হোষ্টেলে। সে সময়ে কলকাতায় মুসলমান ছাত্রদের মাত্র দু’টি হোষ্টেল ছিল। বেকার ও কারমাইকেল হোষ্টেল। এ দু’টি হোষ্টেলই ছিল তখন ভারতবর্ষের ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্র। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বি.এ পাশ করেন।
১৯৪৬ এর নির্বাচনে ফরিদপুর জেলার পূর্ণ দায়িত্ব আসে শেখ মুজিবের উপর। এ নির্বাচনী অভিযানে তিনি ফরিদপুর ছাড়াও খুলনা, যশোর ও বরিশাল জেলার গ্রামে গ্রামে নির্বাচনী তদারকী করেন। ফলে পরিচিত হলেন সব নেতাদের সাথে। যখন বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল, তখনই শেখ মুজিব বুঝতে পারেন এ স্বাধীনতায় পূর্ববাংলার বাঙালীর উপর আর এক নতুন শাসন নেমে শোষণ শুরু হবে। তাই ১৯৪৭ সালের ৩ জুন এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইসলামীয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলাহ্ হলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে তিনি এক সভা করেন এবং সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে মুসলিম লীগ বিরোধী ছাত্র, যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করতে থাকেন। কারণ মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র মুসলিম লীগের কাছে হস্তান্তর হচ্ছিল মাত্র। সিরাজউদ্দৌল্লাহ হলের এ সভাই ছিল পরবর্তী বিরোধী দল সৃষ্টির পটভূমি।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর তিনি মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাশে ভর্তি হন। ৪ জানুয়ারী, ১৯৪৮ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বাংলাদেশ ছাত্রলীগ)। মুসলিম লীগ সরকার একমাত্র উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চক্রান্ত শুরু করলে তার বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান ও কারাবরণ করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর তরুন নেতা সামছুল হক, শেখ মুজিব, আবদুল ওয়াদুদ, অলি আহাদ ও কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে ১৪ মার্চ, ১৯৪৮ গ্রেফতার করা হয় এবং ১৫ মার্চ তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। দেশ বিভাগের পর মুসলিম লীগ সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে যেয়ে মাওলানা ভাসানী ও সামছুল হক এর নেতৃত্বে ২৩ জুন, ১৯৪৯ গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ; সর্বসম্মতিক্রমে মাওলানা ভাসানী সভাপতি ও সামছুল হক সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ নির্বাচিত হন ১ম যুগ্ম সম্পাদক। শেখ মুজিব তখন জেলে ছিলেন। প্রস্তাব রাখা হয় শেখ মুজিবকে ২য় যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার। সভায় পশ্চিম বঙ্গ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসেছিলেন বিরোধী দল গঠনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য। কিন্তু মুসলিম শব্দটির কারণে সে দলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের স্থান না থাকায় ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে পার্টির নাম রাখা হয় আওয়ামী লীগ।
১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ধর্মঘটকালীন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সমর্থন ও অংশগ্রহণ করায় শেখ মুজিবকে পুনরায় গোপালগঞ্জে গ্রেফতার করা হয়। জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে জানতে পারেন যে, তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। সেখান থেকেই তাঁর ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটে।
লিয়াকত আলী খাঁন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দূর্ভিক্ষে প্রায় ২ হাজার লোক মারা যায়। লিয়াকত আলী খাঁন ঢাকা এসে বর্ধমান হাউজে (বাংলা একাডেমী) উঠেন। সে সময়ে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং সামছুল হক ও শেখ মুজিবের প্রচেষ্টায় এক বিরাট ভূখা মিছিল বের হয়। মিছিল রমনার কাছে পৌঁছলেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে, গ্রেফতার হন মাওলানা ভাসানী, সামছুল হক ও শেখ মুজিব। জেলে বসেই ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। শেখ মুজিব প্রস্তাব দেন সোহরাওয়ার্দীকে ঢাকায় আনার জন্যে। মাওলানা ভাসানী, সামছুল হক ও শেখ মুজিবের অনুরোধে সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
২৭ জানুয়ারী, ১৯৫২ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, “উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা”। ঐ সভাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক তরুন জননেতা সামছুল হক দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেন, “বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্টভাষা হবে যেহেতু আমরা শতকরা ৫৬ ভাগ আর আপনারা শতকরা ৪৪ ভাগ”। অতঃপর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্র“য়ারী, ১৯৫২ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শেখ মুজিব তখন জেলে ছিলেন। তিনি জেল থেকে জানতে পারেন যে, ২১ ফেব্র“য়ারী, ১৯৫২ রাজবন্দী মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী দিবস হিসেবে পালন করা হবে। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন বসার দিন ছিল ২১ ফেব্র“য়ারী, ১৯৫২। নূরুল আমীন তখন চীফ মিনিষ্টার, আজিজ আহম্মদ নামে একজন অবাংগালী ছিলেন চীফ সেক্রেটারী, ঢাকার ডিসি ছিলেন রহমুতুল্লাহ নামে আরেকজন অবাংগালী ও আইয়ুব খান ছিলেন ইষ্টার্ণ জোনের জি ও সি। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার ১৮ ফেব্র“য়ারী বিকেলে শেখ মুজিবকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করেন। ২০ ফেব্র“য়ারী বিকেল ৩টায় ভাষা আন্দোলনের প্রস্তাবিত হরতালের বিরুদ্ধে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। সেদিন সন্ধ্যার পর নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্টভাষা কর্ম পরিষদ মাওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতিতে আবুল হাসিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দোহাই দিয়ে ১৪-৪ ভোটে অনিয়মতান্ত্রিক ও বেআইনীভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবেনা বলে সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের আপোষমূলক প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঢাকা হলে (ফজলুল হক হল) বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন- গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, এম.আর. আক্তার মুকুল, জিল্লুর রহমান, আবদুল মোমিন, এস.এ. বারী এটি, সৈয়দ কামরুদ্দীন, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন এবং আনোয়ার হোসেন। ঐ বৈঠকে ৯-২ ভোটে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
একুশে ফেব্র“য়ারী ১৯৫২ বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের প্রাঙ্গন (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ); ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ থেকে ছাত্ররা এসে সভাস্থলে জমায়েত হতে শুরু করলো। সেদিন গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য রাখেন টাংগাইলের কৃতি সন্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সেক্রেটারী তরুন জননেতা সামছুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন এবং বাংলাদেশের প্রয়াত পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রোক্টর মরহুম মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরী এ ব্যাপারে সমর্থন প্রদান করে কলা ভবনের লোহার গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুরু হলো প্রত্যেক দলের ১০ জনের ৩ মিছিল। ৩ দলের নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে হাবিবুর রহমান শেলী, আব্দুস সামাদ আজাদ ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান। এর পর ছাত্রীদের মিছিল। তাঁরা গ্রেফতার হলে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল রাস্তায় বের হয়ে আসে। শুরু হয় ছাত্র-ছাত্রী ও পুলিশের মধ্যে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের পালা। কোন রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই তৎকালীন মেডিক্যাল হোষ্টেলের রাস্তার উল্টোদিক থেকে একদল পুলিশ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কোরেশীর নির্দেশে যমদূতের মতো দৌঁড়ে হোষ্টেলের প্রবেশদ্বারে পজিশন নিয়েই গুলি শুরু করে। চারদিকে টিয়ার গ্যাস এর ধোঁয়ার মধ্যে কেউ কিছু বুঝবার আগেই ঢাকার বুকে সংঘটিত হলো একটি নারকীয় হত্যাকান্ড। কয়েকটি অমুল্য জীবন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। হারিয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র বরকত, জব্বার, রফিক, শফিক এবং ঢাকার বাদামতলীর প্রেস কর্মচারী সালাম। তাঁদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন মহান মাতৃভাষা ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। শেখ মুজিব ১৬ ফেব্র“য়ারী থেকে ২৭ ফেব্র“য়ারী পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবীতে জেলে অনশন ধর্মঘট পালন করেন।
দু’ বছরের বেশীকাল শেখ মুজিবকে বিনা বিচারে জেলে আটক রাখার পর ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে মুক্তি দেয়া হয়। কারামুক্তির পর তিনি সোহরাওয়ার্দীর প্রতিনিধি হিসেবে পিকিং সফর করেন এবং মাওলানা ভাসানীর প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ২য় যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২১ ফেব্র“য়ারী সমগ্র পূর্ব বাংলায় হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিল এবং আর্মানিটোলায় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদুল্লাহ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের শেখ মুজিব। সভায় আন্দোলনের বন্দীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করা হয় এবং শহীদদের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মোনাজাত করা হয়। ৯ জুলাই, ১৯৫৩ ঢাকার মুকুল (আজাদ) সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের ১ম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ ২য় যুগ্ম সম্পাদক এবং সোহরাওয়ার্দী আনুষ্ঠানিকভাবে ১ম সহ-সভাপতি হিসেবে আওয়ামী মুসলীম লীগে যোগদান করেন।
১৯৫৪ সালে শেরে বাংলার “কৃষক শ্রমিক দল” ও আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠন করে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অবতীর্ণ হন। সেই নির্বাচনে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ হতে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পূর্ব বাংলায় শেরে বাংলার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হলে শেখ মুজিব সমবায়, কৃষি ও ঋণ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী জনপ্রিয়তার ভয়ে অল্প দিনের মধ্যেই সেই মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয় এবং শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কৃষক শ্রমিক দল একই কর্মসূচিতে বিশ্বাসী হলেও শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে দেশের স্বার্থ ও আদর্শ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। আবুল হোসেন যুক্তফ্রন্টের কেএসপি নেতা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য মন্ত্রী থাকাকালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পুলিশের গুলি অমান্য করে ক্ষুধার্ত জনতার ভূখা মিছিল বের হয়। মিছিলে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত ও আহত হয় অনেকে। এক যুবকের রক্তাক্ত মৃতদেহ কাঁদে করে শেখ মুজিব এগিয়ে চললেন মিছিলের অগ্রভাগে নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা ভাসানী ও সামছুল হক। এ ভূখা আন্দোলনেই আবুল হোসেন সরকার এর পতন ঘটে।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের রোষানলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুল হক ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে ১৯৫৫ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর আতাউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী পরিষদ গঠন করলে শেখ মুজিব সেই মন্ত্রীসভায় শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দূর্নীতি দমন, গ্রাম উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী হন। পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ফলে ১৯৫৪ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। ৭ জুন, ১৯৫৫ পল্টন ময়দানের এক জনসভা থেকে সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে পূর্ববঙ্গের খাদ্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে শেখ মুজিব তা মীমাংসা করেন। ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদের যুক্ত নির্বাচন বিল গৃহীত হলে জিন্নাহর দ্বিজাতিত্বের পতন ঘটে। একই বছর তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সফরসঙ্গী হিসেবে চীন সফর করেন এবং মাওলানা ভাসানীর প্রতিনিধি হিসেবে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৭ জানুয়ারী, ১৯৫৭ মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান ও শেখ মুজিব দিল্লী সফর করেন এবং মন্ত্রী থাকাকালে তিনি জাপানও সফর করেন।
৭ ফেব্র“য়ারী, ১৯৫৭ আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর আদর্শগত বিরোধ সৃষ্টি হলে এ বিরোধ শেখ মুজিব ও ভাসানীর মধ্যেও দেখা দেয়। ২৫ জুলাই মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে তাঁর সমর্থকদের নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের সমর্থনকারীরা নতুনভাবে গঠন করেন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে এক ব্যক্তি দু’টি পদে থাকতে পারে না। তাই শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন। ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সে সময় তিনি বেতন পেতেন ২০০০ (দুই হাজার) টাকা। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হয়ে শেখ মুজিব রাশিয়া ও ইউরোপ সফর করেন। তিনি জেনেভা অবস্থানকালে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক গন্ডগোলের সুযোগে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে অপসারিত করলে শেখ মুজিব সফর বাতিল করে দেশে ফিরে আসেন। ৮ অক্টোবর, ১৯৫৮ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৬ সালে সংবিধান বাতিল করে দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তন করেন এবং প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও অনেকের সাথে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান ইস্কান্দার মীর্জাকে দেশ হতে বিতাড়িত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। সে সময় শেখ মুজিব প্রত্যেকটি মামলা থেকেই বেকসুর খালাস পান। দেড় বছর কারাভোগের পর ১৯৫৯ সালে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলেও তাঁর উপর দু’বছরের অন্তরীণ জারী করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ আন্দোলনের দায়ে শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেফতার করে ছয় মাস আটক রাখেন। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী মুক্তি পেয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করলে শেখ মুজিব তাঁর সাথে কাজ শুরু করেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
১৯৬৪ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্যে উঠে পড়ে লাগেন। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিলে শেখ মুজিব সম্মিলিত বিরোধী দলীয় প্রার্থী হিসেবে জিন্নাহর ছোট বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহকে দাঁড় করিয়ে নির্বাচন অভিযান পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঐ সময়ে পাকিস্তানে মৌলিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বহাল ছিল। প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা ভোটার ছিলেন। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেক চেয়ারম্যানকে ৫০০ টাকা এবং মেম্বারকে ৩০০ টাকা দিয়ে প্রায় শতকরা ৬৫ ভাগ ভোট ক্রয় করেন। মোনায়েম খানকে চমক দেখানোর জন্য নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে আইয়ুব খান চেয়ারম্যান মেম্বারদের দেয় টাকার নোটসমূহ বাতিল করেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভয়ে বাঙালী চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ যথাক্রমে ৫০০ টাকার ১টি ও ১০০ টাকার ৩টি নোট পুড়িয়ে ফেলেন। এভাবে আইয়ুব খান ছলচাতুরী করে টাকার জোরে ভোট কিনে শতকরা ৬৪ ভাগ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকেন। মিস্ ফাতেমা জিন্নাহ শতকরা ৩৪ ভাগ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন। শেখ মুজিব ও সামরিক শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ আরও তীব্র হলো, শেখ মুজিব চান দেশকে শোষণমুক্ত করতে আর আইয়ুব চান শেখ মুজিবকে ছলে বলে কৌশলে মন্ত্রী বানিয়ে নিজের দলে নিতে। কিন্তু শেখ মুজিব কোনদিনই নিজের স্বার্থের জন্যে দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেননি। ফলে শেখ মুজিবের জীবনের বড় অংশ কেটেছে জেলখানায়। তাই শেখ মুজিব জেলখানাকে দ্বিতীয় বাড়ী বলতেন।
১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে শেখ মুজিব পাকিস্তানের সংহতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। সেই যুদ্ধে পূর্ব বাংলার অসহায় অবস্থা লক্ষ্য করে শেখ মুজিব বাঙ্গালী জাতির আত্ম-প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৮ মার্চ, ১৯৬৬ লাহোরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করলেন। ছয় দফায় ছিল বাঙ্গালীদের বাঁচার ও বাংলাদেশের স্বাধীকারের সুস্পষ্ট দাবী। বস্তুতঃ এ ৬ দফা হলো বাংলার বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ পত্র।
সে সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের চাকুরী এবং রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে যে বিরাট বৈষম্য বিরাজমান ছিল (যা নিরসনে শেখ মুজিব ৬ দফা দাবী পেশ করেছিলেন) তা নিুে প্রদত্ত হলোঃ
বিভাগীয় নাম পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান
কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস ৮৪% ১৬%
পররাষ্ট্র বিভাগের চাকুরী ৮৫% ১৫%
বিদেশী দূতাবাস প্রধান ৮৪% ১৬%
সেনাবাহিনী ৯৫% ০৫%
সামরিক অফিসার ৯৪% ০৬%
জেনারেল পদের সংখ্যা নৌবাহিনী ৮৬% ১৪%
বিমান বাহিনীর বৈমানিক ৮৯% ১১%
সেনাবাহিনী সদস্য ৯৬% ০৪%
পাকিস্তানের এয়ার লাইন্সের সদস্য ৯৬% ০৪%
পি.আই এর ডাইরেক্টর ০৯ জন ০১ জন
পি.আই এর এরিয়া ম্যানেজারের সংখ্যা ০৫ জন ০১ জন
রেলওয়ে বোর্ডের ডাইরেক্টরের সংখ্যা ০৭ জন ০১ জন
জনসংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লক্ষ ৭ কোটি ৫০ লক্ষ
ডাক্তারের সংখ্যা ১২,৪০০ জন ৭,৬০০ জন
হাসপাতালের বেড সংখ্যা ২৬,০০০ টি ৬,০০০ টি
গ্রামীণ চিকিৎসা কেন্দ্র ৩২৫ টি ৮৮ টি
শেখ মুজিব ৬ দফার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন অঞ্চলে জনসভা শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যে ৬ দফার পক্ষে ব্যাপক গণজাগরণ শুরু হয়। ৬ দফা আওয়ামী লীগের দাবী থেকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবী হয়ে দাঁড়ালো, ৬ দফার পক্ষে জনমত গড়ে উঠতে দেখে তৎকালীন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী চরমভাবে শংকিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় নির্যাতন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব এর সহায়তায় সরকারী দলের নেতৃবৃন্দ ‘অস্ত্রের ভাষা’ ও গৃহযুদ্ধের ভয় দেখান এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বারটির বেশী মামলা দায়ের করে হয়রানী শুরু করেন। এপ্রিল, ১৯৬৬ শেখ মুজিব যশোহরে গ্রেফতার হন এবং অতঃপর জামিনে মুক্ত হয়ে ঢাকা ফিরে আসেন। সিলেটের জনসভায় আপত্তিকর বক্তৃতা দেয়ার অভিযোগে তিনি আবার গ্রেফতার বরণ করেন এবং জামিনে মুক্তি পান। জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হবার পূর্বেই ময়মনসিংহের জনসভায় আপত্তিকর বক্তৃতা দেবার জন্যে জেলগেটেই পুনরায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। ৮ মে, ১৯৬৬ নারায়নগঞ্জ থেকে বক্তৃতা দিয়ে বাড়ী ফিরে আসার পর রাত প্রায় ১টার সময় দেশরক্ষা আইনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ শত শত কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় ইত্তেফাকের ছাপাখানা, গ্রেফতার করা হয় ইত্তেফাকের সম্পাদক নির্ভীক সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। তখন কোন একসময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান ঘোষণা করেন, “আমি যতদিন ক্ষমতায় আছি ততদিন শেখ মুজিবকে জেলেই কাটাতে হবে”। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৭১ খ্রিঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই মোনায়েম খানকেই তাঁর বনানীর বাসায় আনোয়ার হোসেন নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা (নবম শ্রেণীর ছাত্র) জানালা দিয়ে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেন।
এ গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৭ জুন, ১৯৬৬ সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটে ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত হয় এবং প্রায় ৮০০ জন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা দায়ের করা হয় বহু কর্মীর নামে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের স্বাধীকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্যে ১৯৬৬ খৃঃ শেষের দিকে গভর্ণর মোনায়েম খানের পরামর্শে পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ শেখ মুজিবকে ভারতের দালাল আখ্যায়িত করে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থের সাহায্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটিয়ে পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা রাষ্ট্র করতে চায়। শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ফাষ্ট লেঃ আবদুর রউফ (বর্তমান গণফোরাম নেতা) এর ভাষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীরা সত্যি সত্যিই পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা রাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। যদিও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূখে তৎকালীন সরকার তা বাতিল করতে বাধ্য হয়। ছাত্র-জনতা যদি জানতেন এ ষড়যন্ত্র মিথ্যা নয় তাহলে হয়ত বা এ আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার ইতিহাস ভিন্ন হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ডিসেম্বর ১ ও ২ তারিখে প্রতিবাদ সভা করে মিছিল বের করে। জনগণের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মাওলানা ভাসানী এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালনের ডাক দেন। তদ্ব্যতীত তিনি পুরো ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন এবং ঘেরাও আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের নাম প্রকাশ করে। তাতে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান আসামী। অন্যান্য আসামীদের মধ্যে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, আহমেদ ফজলুর রহমান সি.এস.পি, এফ সার্জেন্ট মাহফুজুল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস সি.এস.পি, এফ সার্জেন্ট মোঃ ফজলুল হক, সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক খান, এম শামছুর রহমান সি.এস.পি, সার্জেন্ট সামছুল হক, মেজর সামছুল হক, ক্যাপ্টেন মোঃ আবদুল মোতালিব, ক্যাপ্টেন এম. শওকত আলী, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন এ.এন.এন. নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, ফাস্ট লেঃ এম.এম.এম. রহমান, ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দিন আহম্মদ ও ফাষ্ট লেঃ আবদুর রউফ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। শেখ মুজিব ঘোষণা দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনীরূপে অবাধ শোষণের ক্ষেত্র হিসেবে থাকতে চায় না। পূর্ব বাংলা স্বায়ত্ব শাসন চায়। শেখ মুজিবসহ সকল বন্দীর মুক্তির দাবীতে গণবিক্ষোভ দিন দিন বেড়েই যায়। মিছিল, জনসভা ও শ্লোগানের তীব্রতাও বেড়ে যায়।
৬ জানুয়ারী, ১৯৬৯ বিচারকক্ষে শেখ মুজিব তার বিবৃত্তি পাঠ করেন। উক্ত বিবৃতির নাতিদীর্ঘ বিবরণীতে শেখ মুজিব স্পষ্টভাবে বক্তব্য রাখেন যে, “বর্তমান মামলা নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্রের জাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিস্তার করেছে এ মামলা তারই বিষময় প্রতিক্রিয়া”। তাকে আইনগত সহায়তা দেন শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ১ম আইন ও সংসদ বিষয়ক এবং তৎপরবর্তী পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনবিদ ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। শেখ মুজিব নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবী করলে বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র জনতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলো শেখ মুজিবের মুক্তির অগ্নি শপথ। ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর সহ- সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ এর নেতৃত্বে গঠন করা হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
১৭ জানুয়ারী, ১৯৬৯ ছাত্র নেতা তোফায়েল আহম্মদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীরা গণঅভ্যুত্থান শরু করে। শেখ মুজিবের ৬ দফা সমর্থনে ৬ দফার সাথে মিল রেখে এগার দফা দাবী উত্থাপন করেন সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষে আবদুর রউফ (বর্তমান গণফোরাম নেতা), সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মানিক (প্রয়াত গণফোরাম নেতা), সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, সামছুদ্দোহা (বর্তমান গণফোরাম নেতা), সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, মোস্তফা জামাল হায়দার, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, দীপা দত্ত, সহ সম্পাদিকা, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, তোফায়েল আহম্মদ (বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা), সহ-সভাপতি, ডাকসু, নাজিম কামরান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু।
২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (সোহরাওয়াদী উদ্যান) ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে লাল গালিচা সম্বর্ধনা দেয়া হয়। ঐ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে ডাকসু-র সভাপতি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহম্মেদ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন।
বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, বুদ্ধিজীবিসহ আপামর জনসাধারণ এ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়। এ আন্দোলন দমন করার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলে আইয়ুব-মোনায়েমের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং বিনাশর্তে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। যাকে দেশদ্রোহী বলে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলানোর ব্যবস্থা করানো হয়েছিল তাঁকে মুক্তি দিয়ে ১৯৬৯ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সর্বদলীয় নেতাদেরকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন এবং অচলাবস্থা দূর করার পথ খুঁজতে লাগলেন। গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার পর ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ প্রধান সেনাপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নিকট লিখিত এক পত্রে আইয়ুব খান দেশের তদানিন্তন গুরুতর পরিস্থিতি আয়ত্ব আনতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে তাকে শাসন ক্ষমতা গ্রহণের অনুরোধ জানালে পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের জন্য সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয় এবং ১৯৬২ সালে এর শাসনতন্ত্র, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহ বাতিল বলে ষোষিত হয়। সামরিক সরকারের ১৯৭০ সালের ২৮ মার্চের ও ১৫ আগষ্টের ঘোষণা মোতাবেক ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এদিকে নির্বাচনের পূর্বেই ১২ নভেম্বর, ১৯৭০ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসে ভোলা, নোয়াখালীসহ উপকূলীয় দ্বীপসমূহের জানমাল গৃহাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রায় ১০ লক্ষ লোক মুত্যুবরণ করে। শেখ মুজিব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ড. কামাল হোসেন প্রমূখ নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দুঃস্থ মানবতার সেবায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়ায়। অথচ পাক সরকার শুধুমাত্র সমবেদনা জ্ঞাপন করেই ক্ষান্ত হন। ভাসানী ঘূর্ণিদূর্গত এলাকা ঘুরে এসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষে শেখ মুজিবকে সমর্থন দেন। ফলে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর আরও বৃদ্দি পায়। বস্তুতঃ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসের জন্যে কতকগুলো আসনের নির্বাচন পরে অনুষ্ঠিত হয়। এ সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন দখল করে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮২ আসন পেয়ে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মূলতঃ আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হলেন মুকুটহীন রাজা। এ নির্বাচনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কেননা এ নির্বাচনে জনগণ ৬ দফার প্রতি ম্যান্ডেট দান করে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা এ অভূতপূর্ব জনসমর্থনের পরেও যখন বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দিলেন না তখন পাকিস্তানের ভাঙ্গন অনিবার্য্য হয়ে উঠে। কেননা সুসংহত এক দল বৈধভাবে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়েও যখন শাসন ক্ষমতা লাভে ব্যর্থ হয় তখন সংগত কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বতঃফূর্তভাবেই বিপ্লবের পথ বেছে নেয়। শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্র“য়ারীর মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার জন্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দেন। প্রেসিডেন্ট তথা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবর্গ এবার স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী জাতিকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না, তাই তারা নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগলেন। ১৩ ফেব্র“য়ারী ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের কথায় কর্ণপাত না করে পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টোর কথামত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেন ৩ মার্চ, ১৯৭১। পরবর্তীতে শেখ মুজিব ভূট্টো ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার বিষয়ে সম্ভাব্য সব ধরনের আপোষ আলোচনা করেন। প্রতিটি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনবিদ গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। শেখ মুজিব ও তার দল ৩ মার্চের অধিবেশনের যোগদানের জন্যে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন আকস্মিকভাবে ১ মার্চ করাচী হতে এক বিবৃতির মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের দু’অংশের নেতাদের মধ্যে রাজনীতিগত বিরোধ দেখা দিয়েছে। এ বিরোধ অবসানের অবকাশ সৃষ্টিকল্পে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। ৩ মার্চের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করায় ১ মার্চ বিকাল হতে বাঙালী জাতি বিক্ষোভে ফেটে করে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের এক বিরাট জনসভায় শেখ মুজিব স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন উঠে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের বাণী ও নির্দেশ আইন হিসেবে পালিত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবস্থা গুরুতর বুঝে ১০ মার্চ ঢাকায় সকল দলের রাজনৈতিক নেতাদের এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। শেখ মুজিব তাতে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন- “বন্দুক উঠিয়ে এ গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করা হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র মানুষকে নির্মম ও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এ হত্যাকারীদের সঙ্গে কোন বৈঠক হতে পারে না”। পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার প্রয়াসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৬ মার্চ ঘোষণা করেন যে, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এদিকে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের এক ঐতিহাসিক জনসভায় বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান দশ লক্ষাধিক মানুষের জনসমাবেশে চার দফা দাবী পেশ করেন ২৫ মার্চের অধিবেশনে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে। দাবীগুলো ছিলঃ (ক) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, (খ) সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেয়া, (গ) সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র গণহত্যা তদন্ত করা ও (ঘ) জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনে শেখ মুজিব বলেন- “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, রক্ত দিতে আমি প্রস্তুত রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে”। মাওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবের নির্দেশিত চার দফার সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেন। আতাউর রহমান শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন- “এ মুহুর্তে আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার গঠন করুন”। এরপর ১৫ মার্চ আর এক দফা শাসনতান্ত্রিক সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে আলোচনার জন্যে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। সঙ্গে আসেন সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ ও পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ৩৫ জন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ (জাতীয় পরিষদ সদস্য)। ইতোপূর্বেই টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর করা হয়েছে। ১৬ মার্চ হতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ড. কামাল হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের আলোচনা চলে। অপর পক্ষে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানের বিরাট জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
২৫ মার্চের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল নেতৃবৃন্দ করাচী চলে গেলেন। সরল বিশ্বাসে শেখ মুজিব ও তাঁর দল যখন ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২.২৫ মি. পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে ফেরার পর ৪ দিন পর লালমাটিয়ার একটি বাসভবনে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় গ্রেফতার করা হয় ড. কামাল হোসেনকে। অতঃপর পাকিস্তানের সামরিক সরকার আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ভাসানীসহ অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে বেআইনী ঘোষণা করে। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাক সামরিক বাহিনীকে বাংলার শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর লেলিয়ে দেয়া হয়। তারা ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ফলে ঐ রাতে শুধু ঢাকা শহরেই পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক মারা যায়।
২৩ মার্চ বুয়েটের ২ জন শিক্ষক দ্বারা তাঁর বাসায় ওয়ারলেস স্থাপন করা হয়। রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার আক্রমণের খবর ও গুলির আওয়াজ পাওয়ার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাত ১২.০৫ মিঃ থেকে ১২.১৫ মিঃ পর্যন্ত কয়েকবার ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘোষণাটি নিম্নরূপঃ
“ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চুড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।
তাঁর এ ঘোষণা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি থানা ও ইপিআর পোষ্টে পৌঁছে যায়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ১২.২৫ মিঃ অর্থাৎ ২৬ মার্চ ভোর ০.২৫ মিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাঁর বাসভবন থেকে ও ৪ দিন পর লালমাটিয়া থেকে ড. কামাল হোসেনকে লেঃ কর্ণেল জেড.এ. খান ও মেজর বিলাল এর নেতৃত্বে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করার পর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ৯ মাস পশ্চিম পাকিস্তানের ২টি পৃথক কারাগারে আবদ্ধ করে রাখে।
২৬ মার্চ ভোরবেলা চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রের স¤প্রচার বন্ধ করে বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে রেডিওর কিছু স্ক্রিপ্ট লেখক, শিল্পী, প্রযোজক চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন। এ বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ আনুমানিক বিকেল ২.৩০ মিঃ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এম.এ হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী স্বকণ্ঠে প্রচার করেন। ২৭ মার্চ, ১৯৭১ আনুমানিক সকাল ১১.৩০ মিঃ বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে একমাত্র সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার রাখে এমন বক্তব্যের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে মেজর জিয়া ভুলক্রমে প্রথমে নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এম.এ হান্নান ও মেজর জিয়ার ঘোষণা চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৬০ কি.মি. এর বাইরে যায়নি। পরে অর্থাৎ ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যা ৬.৩০ জনাব এম.আর সিদ্দিকীসহ চট্টগ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের চাপের মুখে ক্ষমা চেয়ে ভুল সংশোধন করতঃ বাংলাদেশের অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা ৩০ মার্চ দিনের প্রথমার্ধ পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন কর্তৃক স¤প্রচার করা হয়। জিয়ার ৬.৩০ মিঃ এর ঘোষণা ভারতের বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র থেকে স¤প্রচার করা হয়, যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পৌঁছে যায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন (আবু), পিতা – মৃত মৌলভী খোরশেদ আলী, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিকেল ৪.৩০ মিঃ টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়নের খরশিলা গ্রামের ঈদগাঁ মাঠে আনুমানিক ২/৩ হাজার লোকের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতে গিয়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে ১১ নং সেক্টরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তিনিও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক। কিন্তু তিনি কখনও এ ঘোষণার জন্য রাষ্ট্র বা সমাজের কাছে কোন প্রকার সম্মান বা মর্যাদা দাবী করেননি।
অর্থাৎ শেখ মুজিবের ২৫ মার্চ রাতে তথা ২৬ মার্চ, ১৯৭১ রাত ১২.০৫ মি. থেকে ১২.১৫ মি. পর্যন্ত সর্বশেষ আদেশ ও তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবিসহ বাঙালী সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সদস্যগণ তথা আপামর জনসাধারণ মুক্তিযোদ্ধা সেজে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীয় সহায়তায় বাংলাদেশকে পরাশক্তির কবল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এ নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে আত্মদান করেছেন ৩০ লক্ষের অধিক নর-নারী, সম্ভ্রম হারিয়েছেন ৩ লক্ষের অধিক মহীয়সী মাতা ও ভগ্নি, গৃহহারা হয়েছেন এক কোটিরও বেশী মানুষ (যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন) এবং ছিন্নমূল ও সর্বহারা হয়েছে অসংখ্য জনসাধারণ। এতদ্ব্যতীত ৫০ হাজারের অধিক সংখ্যক যুদ্ধ সন্তানের জন্ম হলে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই তাঁদেরকে বিদেশে (ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহে) পাঠিয়ে দেন। শেখ মুজিব ও ড. কামাল হোসেন এ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২ শেখ মুজিব স্বগৌরবে দেশে ফিরে আসেন স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের আপন জনগণের কাছে; সঙ্গে ছিলেন ড. কামাল হোসেন। সেদিন থেকেই মূলতঃ দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস শুরু হয়। তিনি দেশে ফিরে এসে ১১ জানুয়ারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারী করেন। সংবিধান রচনার পূর্ব পর্যন্ত এ অস্থায়ী সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৩ মার্চ, ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি এক গণপরিষদ আদেশ জারী করেন। এ আদেশ ২৬ মার্চ, ১৯৭১ থেকে কার্যকর বলে ধরা হয়। এ আদেশ অনুসারে ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ হতে ১০ জানুয়ারী, ১৯৭১ পর্যন্ত জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের আসনসমূহে বাংলাদেশ হতে নির্বাচিত সকল গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদের উপর সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১০ এপ্রিল, ১৯৭২ বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বর্তমানে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। আইন মন্ত্রী ছাড়াও এ কমিটিতে আরও চারজন মন্ত্রীকে নেয়া হয়। তারা হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, খন্দকার মোশতাক আহম্মদ ও জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান। এ কমিটি ১০ জুনের মধ্যে পরিষদ সচিবালয়ের নিকট খসড়া সংবিধান পেশ করে। খসড়া সংবিধান সংসদ কর্তৃক পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর ৪ নভেম্বর পরিষদ সদস্যদের তুমুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। অন্যদিকে শোষণহীন তথা সমাজবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রবর্তন করার লক্ষ্যে ২৬ মার্চ, ১৯৭২ শেখ মুজিব ও তাঁর সরকার বাংলাদেশের প্রচলিত তফসীলভূক্ত ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহকে জাতীয়করণ করেন যদিও তাঁর দলের বৃহৎ অংশ বুর্জোয়া অর্থনৈতিক আদর্শে গড়ে উঠেছিলেন। বস্তুতঃ বুর্জোয়া অর্থনীতিতে গড়ে উঠা নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনিক আমলাদের দ্বারাই দেশের ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে ৭ মার্চ, ১৯৭৩ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মত এবারেও অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে ১৫টি মহিলা আসনসহ বাংলাদেশের ৩১৫ আসনের মধ্যে ৩০৭ আসন লাভ করে সরকার গঠন করে। একই বছর শেখ মুজিব বিশ্বশান্তির প্রতীক “জুলিওকুড়ি” পুরস্কারে ভূষিত হন।
স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ মুজিববাদের চার অন্যতম সংগঠকের মধ্যে মার্কসবাদে বিশ্বাসী সিরাজুল আলম খান ১৯৭২ সালের প্রথমার্ধে শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক দলসহ পার্লামেন্ট বাতিল করে বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে সমাজতান্ত্রিক নীতি প্রণয়ন করার জন্য পরামর্শ দেন। শেখ মুজিব তাতে রাজী না হওয়ায় সিরাজুল আলম খান ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২ মেজর (অবঃ) এম.এ. জলিলকে সভাপতি, আ.স.ম. আবদুর রবকে মহাসচিব এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাজাহান সিরাজকে সহসভাপতি করে ছাত্রলীগের ভিন্ন মতাবলম্বী অংশের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তারুণ্য নেতৃত্বে গঠিত বিপ্লবী গণবাহিনীর দূর্বার আন্দোলনের মুখে মুজিব সরকারকে হিমসিম খেতে হয়। অপরপক্ষে, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকান্ড বাঙালী জাতীয় জীবনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এহেন পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব গঠিত রক্ষী বাহিনীকে সন্ত্রাসবাদ দমনে নিয়োজিত করা হয়। অপরদিকে ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যার ফলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ এক চরম দূর্দশার মধ্যে পতিত হয়। দূর্ভিক্ষে অনাহারে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। তৎকালীন সরকার রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধুমাত্র দমননীতির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে রক্ষী বাহিনী নিয়োগ করেন। ফলে রক্ষী বাহিনীর মাত্রাধিক্য দমনমূলক কার্যকলাপে বহু তরুণ-জীবন অকালে হারিয়ে যায়। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারকে ২ জানুয়ারী, ১৯৭৫ শেখ মুজিবের শাসনামলে রক্ষী বাহিনীর হেফাজতে অকালে জীবন দিতে হয় যা জাতির জন্যে খুবই লজ্জাজনক। অপরদিকে মুজিব সরকারের দূর্ণীতিপরায়ণ অংশের ব্যাপক দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি ও অপকর্মকান্ড দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এতদ্ব্যতীত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখনও বিশ্ব রাজনীতির দাবানলে পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগে ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। এমন তিক্ত পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব ২৫ জানুয়ারী, ১৯৭৫ সম্ভবতঃ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির অভিষ্ট লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের সর্বশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ সংবিধান (৪র্থ সংশোধনী) আইন’ ৭৫ পাস করে এবং বহুদলীয় রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা রহিত করতঃ আওয়ামী লীগ বাতিল করে এক দলীয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এতে তাঁর দলসহ জাতীয় সম্পদ লুটপাটের মাধ্যমে কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারী সম্পদ খোয়ানের ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেলেন।
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ মহাপুরুষ তথা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী। তাঁর ৪ খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আদর্শ মানুষ ছিলেন। ১৯৪৭ সালে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। জন্মলগ্ন থেকেই কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র নেতৃত্বে পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিলেন অবহেলিত ও বঞ্চিত। এ অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষায় সংগ্রাম করেছেন শেরে-বাংলা এ,কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামছুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অগনিত নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ; তন্মধ্যে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছাত্র আন্দোলন ও ১৯৬৯-র গণঅভ্যূত্থান অন্যতম। বাংলার মানুষের স্বাধীকার তথা রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ খ্রিঃ থেকে ১৯৭১ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর জেল খেটেছেন। বেশ কয়েক বছর জেল খেটেছেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামছুল হকসহ আরও অনেক প্রতিভাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
১৯৬৯ খ্রিঃ গণঅভ্যূত্থানের সময়ে মহান আল্লাহ্ পাকের অশেষ কৃপায় জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এমন উচ্চতার আসনে বসিয়েছিলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর শাসনামলের চিত্রকে সামনে রেখে তার অনুকরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ট প্রভাবশালী ৪ ছাত্রনেতা নূরে-আলম সিদ্দিকী, আ.স.ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুছ মাখন বঙ্গবন্ধুর ৪ খলিফা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন যা নজিরবিহিন ও পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।
আওয়ামী লীগ সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মাত্র ছয় মাস শাসনামল এবং বাকশাল পদ্ধতি প্রয়োগের প্রস্তুতি নিতে না নিতেই বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী বুর্জোয়া অর্থনীতিতে বিশ্বাসী, ধনিক শ্রেণীর দোসর, আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা খন্দকার মোশতাক আহম্মদের নেপথ্য পরিচালনায় ল্যান্সার ইউনিটের লেঃ কঃ ফারুক রহমান ও আর্টিলারী ইউনিটের লেঃ কঃ খন্দকার আবদুর রশিদ এর নেতৃত্বে পরিচালিত সেনাবাহিনীর ১২ জন সামরিক কর্মকর্তা একে অপরের সাথে যোগসাজস করে (দু’টি ইউনিট- একটি ল্যান্সার ও অন্যটি আর্টিলারী) ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ ভোর রাতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী ও বাংলাদেশের স্থপতি আফ্রো-এশিয়া মহাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারসহ, শেখ মুজিবের ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে পরিবারসহ ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনিকে পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখানেই তাঁর সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটে। এতে রাজনৈতিক শক্তির লেবাসে ক্ষমতায় আসে সামরিক শক্তি। বেসামরিক রাজনৈতিক শক্তির সর্বশেষ সংগঠন বাকশালেরও কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সর্বোপরি ভূলুণ্ঠিত হলো জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি।
শেখ মুজিবকে যখন স্বপরিবারে হত্যা করা হয় তখন তাঁর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান। ঐ সময় শেখ হাসিনা জার্মানস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত প্রয়াত হুমায়ন রশিদ চৌধুরীর বাসায় আশ্রয় নেন। অতঃপর ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদেরকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দিলে শেখ হাসিনা তা গ্রহণ করতঃ ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের কোন্দল দেখা দেয়। যার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে আওয়ামী লীগ (মালেক) এবং আওয়ামী লীগ (মিজান) সৃষ্টি হয়। এদিকে পুনরায় ১৯৮০ সালের শেষার্ধে আওয়ামী লীগে (মালেক) নেতৃত্বের যে কোন্দল দেখা দেয় তা ১৯৮১ সালের প্রথমার্ধে তীব্র আকার ধারণ করে। দলের নেতৃবৃন্দের বৃহত্তর অংশ দলীয় প্রধান হিসেবে ড. কামাল হোসেন এর নাম প্রস্তাব করেন, বাকী অংশ আবদুল মালেক উকিলের নাম প্রস্তাব করেন। ড. কামাল হোসেন বুঝতে পারলেন দলের ভাঙ্গন অবশ্যম্ভাবী। তাই দলকে সম্ভাব্য ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষার্থে ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের (মালেক) সভানেত্রী করার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে ড. কামাল হোসেন ১৭ মে, ১৯৮১ শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এভাবেই এককালের ছাত্রলীগ কর্মী, পরবর্তীকালের গৃহিনী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের প্রথমার্ধে ভারতের নির্বাসিত জীবন থেকে বাংলাদেশে এসে আওয়ামী লীগের (মালেক) সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে আওয়ামী লীগ (মালেক) আওয়ামী লীগ (হাসিনা) নামে অভিহিত হয়।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের (হাসিনা) প্রার্থী হিসেবে ড. কামাল হোসেন প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। পরবর্তীতে মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগ (মিজান) বিলুপ্ত করে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। ফলে আওয়ামী লীগ (হাসিনা) পুনরায় আওয়ামী লীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৭ ফেব্র“য়ারী, ১৯৯১ অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হলে দলে সিনিয়র নেতাদের সাথে শেখ হাসিনার সম্পর্ক শীতল হয়। মহিউদ্দিন আহম্মদ ও আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর গড়া বাকশাল বিলুপ্ত করে বাকশাল থেকে উত্তরিত আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এহেন অবস্থার প্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের একাংশ, কমিউনিষ্ট পার্টির একাংশ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) একাংশ ও জাসদের একাংশকে নিয়ে ২৯ আগষ্ট, ১৯৯৩ গণফোরাম গঠন করেন।
দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর রাজনৈতিক চড়াই উৎরাই এর পর ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুধু তাই নয়, সমগ্র বিশ্বে শেখ মুজিবের সুযোগ্য কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি দেশরতœ উপাধিতে ভূষিত হন। তবে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন সংঘটিত দুর্নীতির অভিযোগে বিচারাধীন মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জরুরী অবস্থাকালীন দীর্ঘ ১১ মাস কারারূদ্ধ থাকার পর জামিনে মুক্তি পান। অতঃপর ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮ এর সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তিনি ৫ জানুয়ারী, ২০০৯ দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পরবর্তীতে ৫ জানুয়ারী, ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তিনি তৃতীয়বার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরোপ্রধান