৭ জুন ২০২৫, শনিবার- ব্যুরো অফিস, দৈনিক রাঙামাটি
গত ২৮ মে ২০২৫ বুধবার, বিকাল ৫টায় ঢাকার বাংলামোটরে অবস্থিত বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে প্রস্তাবিত- ‘মঠবাড়িয়া পর্যটন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সুন্দরবন পর্যটন ক্লাব’ এর উদ্দ্যোগে ‘দেশের পর্যনটশিল্প উন্নয়নে লোকজ সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব- শীর্ষক আলোচনা সভা, শিশুশিল্পী মানহা ইসলামের প্রথম একক আবৃত্তি সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। আয়োজনের আলোচনা পর্বের মান্যবর অতিথি ও ‘সুন্দরবন পর্যটন ক্লাব সম্মাননা’ প্রাপ্তজন চলচ্চিত্র ও নাট্য পরিচালক, প্রযোজক, বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা শহীদ রায়হান আলোচ্য বিষয়ের উপর যে বক্ত্য দেন তা এখানে তুলে ধরা হলো। ঐ দিন উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন-
আজ যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি, তা আমাদের মাটি, মানুষ আর মননের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সেটি হলো বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে লোকজ সংস্কৃতিক চর্চার গুরুত্ব। যখন আমরা বলি ‘পর্যটন’, তখন কেবল সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, আমরা বলি, অনুভবের কথা। পর্যটন মানে হলো সেই অভিজ্ঞতা, যা মনে থেকে যায়; যে গল্প শোনার পর বিদেশিরা আমাদের দেশকে আপন করে নিতে চায়। এমন এটা অনুভব থেকে আমরা খুজে দেতে চাই-
লোকজ সংস্কৃতি মানে কী?
লোকজ সংস্কৃতি মানে কেবল যাত্রাপালা নয়, কেবল একতারা নয়, এটা হলো গ্রামের সেই বুড়ো বাউল, যার গানে মাটি কাঁদে। লোকজ সংস্কৃতি মানে, সেই নকশীকাঁথা, যেখানে এক মা তার জীবনের গল্প আর অভিজ্ঞতা সুনিপুণ হাতে সেলাই করে দেন। এটি হলো মাঘের পিঠা, আষাঢ়ের ঝুমবৃষ্টিতে ঢোলের তালে গম্ভীরা, কিংবা গহীন গাঁওয়ে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছায়ার মতো ভেসে ওঠা আলকাপ দলের রঙ্গমঞ্চ। ঝিঝি পোকার কলরব যেখানে আবহ সংগীত সেখানে-
পর্যটনের ভাষায় লোকজ সংস্কৃতি কীভাবে মূল্যবান?
সেটি বিশ্লষন করে দেখা এখন সময়ের দাবী- আজ বিশ্ব পর্যটনে এক নতুন ধারা এসেছে ঊীঢ়বৎরবহপব ঞড়ঁৎরংস বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক ভ্রমণ। পর্যটকরা আজ আর শুধু পাহাড় বা সমুদ্র দেখতে চায় না, তারা চায় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে গল্প করতে, তাদের খাবার খেতে, তাদের উৎসবের অংশ হতে। এই অভিজ্ঞতা দেওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে, লোকজ সংস্কৃতি।
বিশ্বে এই কৌশলে সফল কিছু উদাহরণ দিই: যেমন- ভিয়েতনাম: তারা হানয় শহরের কাছের গ্রামে লোকসঙ্গীত ও মৃৎশিল্প প্রদর্শন করে। জাপান: প্রামীণ পল্লীতে চা তৈরির রীতি পর্যটকদের সামনে উপস্থাপন করে। ভুটান: লোকজ উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছর হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক টানে।
বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন?
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন আঠে, বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন? বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিকে আমরা নজর দিতে পারি-
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে আছে একেকটি সাংস্কৃতিক জাদুঘর।
কুষ্টিয়ার বাউল গান, নেত্রকোনার গীতিকা কাহিনী, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ও মারমাসহ সব জাতিগোষ্ঠীর নৃত্য (সাংস্কৃতিক বৈচিত্র), রাজশাহীর গম্ভীরা, সিলেটের ধামাইল গান-নৃত্য, ময়মনসিংহ গীতিকা, নকশীকাঁথা, মাটির হাঁড়ি, ঢাকাই জামদানী, চিত্রা নদীর নৌকা বাইচ, বরিশালের লাঠি খেলা ইত্যাদি; আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের অংশ, যা পর্যটনের পণ্য হতে পারে, যদি আমরা চেষ্টাটা করি এবং দৃড় কন্ঠে উচ্চারণ করতে পারি-
লোকজ সংস্কৃতি ছাড়া পর্যটনের উন্নয়ন অসম্পূর্ণ?
সম্মানিত নাগরিক, নীতি নির্ধারকদের মনেরাখতে হবে, আমরা যদি কেবল বিল্ডিং বানিয়ে ‘রিসোর্ট’ করি, তবে তা কয়েকজনের জন্য আয়ের অবলম্বন হতে পারে। কিন্তু যদি আমরা স্থানীয় সংস্কৃতি- খাদ্য, পোশাক, নৃত্য-গীত ও উৎসবের সঙ্গে পর্যটনকে যুক্ত করি তবে একটি সম্পূর্ণ কমিউনিটি তার জীবিকার সন্ধান পাবে, উপকার পাবে। এতে আয় বাড়বে স্থানীয় শিল্পী, হস্তশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী, কৃষক, রন্ধনশিল্পীরা। এমনকি গ্রামে তৈরি হবে পর্যটন গাইড। এতে গ্রামীন যুব সমাজ কাজের ক্ষেত্র পাবে, পাবে আত্মপরিচয়ের গর্ব। দেশের অর্থনীতি পাবে এক নতুন টেকসই ভিত্তি।
আমাদের করণীয় কী?
আসুন আমরা ভাবি, নির্ধারণ করি আমাদের করণীয় কী?
১. একটি জাতীয় পর্যায়ের লোকজ পর্যটন নীতিমালা গঠন করতে হবে। ২. গ্রামীণ হোম-স্টে চালু করে পর্যটকদের পল্লী জীবনের অংশ হতে দিতে হবে। ৩. লোকসংস্কৃতি উৎসবগুলোকে আন্তর্জাতিক রূপে রূপান্তর করতে হবে, যেমন- ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ইধঁষ ঋবংঃরাধষ, ঋড়ষশ অৎঃ ঋধরৎ, চরঃযধ চধৎনড়হ ভড়ৎ ঞড়ঁৎরংঃং। ৪. স্মার্ট ডিজিটাল প্রচার- লোকগান, যাত্রাপালা, বাউলদল গান এসবের সংক্ষিপ্ত ভিডিও ও ভিজ্যুয়াল গল্প আন্তর্জাতিক দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। ৫. বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করতে হবে, ঠরষষধমব ইধহমষধফবংয: ঞযব ঝড়ঁষ ড়ভ ঝড়ঁঃয অংরধ শিরোনামে।
সব শেষে আমি বলতে চাই-
লোকজ সংস্কৃতি হচ্ছে, আমাদের হৃদয়ের ভাষা, আমাদের পূর্বপুরুষদের সত্তা। পর্যটন হচ্ছে, বিশ্বের সামনে সেই সত্তাকে তুলে ধরার মাধ্যম। তাই এই দুটিকে আমরা যদি এক সূত্রে গাঁথতে পারি, তবে শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, বাংলাদেশের মর্যাদাও বিশ্বমঞ্চে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। চলুন, আমরা সবাই মিলে এই কাজটা শুরু করি- শুধু উন্নয়নের কথা নয়, ভালোবাসার গল্প দিয়ে, সংস্কৃতির সৌন্দর্যে ভর করে। বাংলাদেশের পর্যটন হোক মানুষের জন্য, লোকজের আলোয়, হৃদয়ের আলো।
লেখক- শহীদ রায়হান
পরিচালক, প্রযোজক, বিজ্ঞাপনচিত্র-প্রামান্যচিত্র নির্মাতা
আপলোড, শামিমুল আহসান
ঢাকা ব্যুরো প্রধান, দৈনিক রাঙামাটি