॥ মনিরুজ্জামান মনির ॥
বর্তমান সরকার ভূমি আইন ২০২০ (খসড়া) জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। এজন্য সরকারকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে এই ভূমি আইনের সবগুলো ধারা উপধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা রাখি। একটা কথা অনেকেই ভুলে যান কেন তা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বোধগম্য নয়। সেটি হল মুক্তিযুদ্ধ আমরা করেছিলাম বর্বর হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। ভূমি আইন ২০২০ এখনো খসড়া অবস্থায় আছে, চুড়ান্ত করার লক্ষ্য নিয়েই এটা জাতির মতামত চেয়ে পেশ করা হয়েছে। কোন ক্ষুদ্র জাতিসত্বা, জাতি-উপজাতি ও মুসলিম বিরোধী শক্তিকে খেপানোর জন্য এই আইন করা হবেনা। সমগ্র জাতির কল্যানের রাস্তা বের করতেই এই খসড়া। অথচ ইতোমধ্যেই এই ভূমি আইন ২০২০ কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কটু মন্তব্য করা হচ্ছে যা খুবই দুঃখজনক। “বিবেচনায় নেয়ারও অযোগ্য এই ভূমি আইনের খসড়া”- কি আজব কথা?। সরকার শিগগিরই ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে ভূমির ই-নামজারি- মিসকেস মামলার শুনানি গ্রহণ শুরু করতে যাচ্ছেন। জনগণের ভূমিসেবা সহজীকরণের জন্য ভূমি আইন-২০২০ একটি যুগান্তকারী বৈপ্লবিক পদক্ষেপ- তা নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। বিবেকবান বাংলাদেশী নাগরিকগণও তাই বলছেন।
বিশ্বের কোথাও ভূমির অধিকার (ল্যান্ড রাইট) স্থানীয় সরকারের অধীনে ন্যাস্ত করা হয় না। দেশের কেন্দ্রীয় সরকার ভূমি বন্টন, খাস জমির চিহ্নিত করণ, বরাদ্দ, একুজেশন, রিকুইজেশন, বন্দোবস্তী, ক্যাডেস্টাল সার্ভে ইত্যাদি দেখভাল করে থাকেন। কার্যত এটাই হওয়া উচিত। প্রথাগত ভূমি অধিকার এর নামে বিশেষ গোষ্টি, রিষ্টপুষ্ট হবেন অন্যদিকে ভূমিহীনদের অধিকার হরণ করে তাদেরকে শাসন-শোষন করবেন এই মানবাধিকার লঙ্গন আর কতকাল চলবে? ভূমি চাষিরা গাবুর খাটবে অথচ ভূমি দখলকারী, হ্যাডম্যান কারবারি, মৌজা প্রধান সুবিধা ভোগ করবেন। এই বৈষম্য অবসান হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের ভূমি আইন একটি জটিল বিষয়। চুড়ান্ত করার আগে খসড়া আইনটি ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা সংযোজন, বিয়োজন আবশ্যক। সাবেক বিচারপতি ও ব্লাস্ট এনজিওর প্রধান আইন উপদেষ্টা মোঃ নিজামুল হক বলেছেন “আইন কমিশন তাদের মত (খসড়ার মাধ্যমে) তুলে ধরেছেন। এখন অন্যদের উচিত তাদের মতামত ও আপত্তির বিষয়টি তুলে ধরা। কিন্তু কোন কোন সাম্প্রদায়িক সংগঠন, বিতর্কিত এনজিও এবং বিতর্কিত ব্যক্তির মন্তব্য খুবই অশালিন, আপত্তিকর, অসাংবিধানিক ও নিন্দনীয়। তারা একে খসড়া বলেও মানতে রাজি নন। খসড়াটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের সাথেও নাকি সাংঘর্ষিক। এধরনের হামবড়া এক পেশে মনোভাব জাতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। এসব গোয়ারতুমি ব্যক্তিদের মনোভাব অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত। বিশেষ উদ্বেগের কারণ হলঃ কক্সবাজারের মেজর সিনহার ঘাতক বহুল বিতর্কিত বরখাস্ত ওসি প্রদীপ বাবুর পক্ষাবলম্বনকারী জনৈক আইনজীবী রানাদাস গুপ্ত সম্প্রতি ভূমি আইন ২০২০ নিয়ে অতি রহস্যজনক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে হিন্দু-বৌদ্ধ-খিস্টান ঐক্য পরিষদ, নিজেরা করি, সন্তু লারমার নেতৃত্ত্বাধিন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম (সনজিবদ্রং গারো), ব্লাস্ট, এএলআরডি, আরডিসি (মেজবা কামাল), আইন ও শালিশ কেন্দ্র, টিআইবি, সিপিডি ইত্যাদি এনজিও ভূমি আইন ২০২০ এর গঠনমূলক পরামর্শ সাজেশান ইত্যাদি না দিয়ে পুরো আইনটি বিকৃতভাবে প্রচার করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক উসকানি দিচ্ছেন এবং বর্তমান সরকারকে বিব্রত করছেন। যা মোটেও উচিত নয়।
বাংলাদেশ একটি শান্তি সম্প্রীতির দেশ। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ এবং রনাঙ্গনের কঠিন যুদ্ধে জয়লাভ করে জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ৫০ বছরে জাতি পা দিয়েছে এখনও অনেক বাধা বিগ্ন মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি মহল ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারী ইত্যাদি জাতীয় দিবসকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন না। এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্র নাই এমন ব্যক্তি সরকারের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের পদটি একযুগেরও বেশি কাল ধরে ভোগদখল করে যাচ্ছেন। সরকারের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে মাঝে মাঝে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেন অথচ আইন তাকে মোটেও তার আওতায় আনতে পারছেন না। মানবাধিকারবাদীরাও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী বেআইনী অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন না। বরং তথাকথিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে সন্তুলারমার হাত শক্তিশালী করতে দালালিপানা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন? বাংলাদেশের ভূমি আইন-২০২০ (খসড়া) ব্যাপকভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হউক। নতুন নতুন প্রস্তাব পরামর্শ দেওয়া হউক এবং জাতির সামনে প্রকৃত জনকল্যাণকর ভূমি আইন রচিত হউক। এটি আমাদের সবার একান্ত প্রত্যাশা।
মন্তব্য কলাম (মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়) লেখকঃ [বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান মনির, এফএফ সেক্টর-২, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এবং সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাঙামাটি জেলা ইউনিট।]