॥ আনোয়ার আল হক ॥
এক, একাধিক বা শতাধিক মানুষ একত্র হয়ে মাজার ভাঙ্গার যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা কোনো দৃষ্টিকোন থেকেই সমর্থনযোগ্য নয়। কোনো সন্দেহ নেই যে, মাজার মুসলীম সংস্কৃতির একটি অংশ। তবে প্রণিধান যোগ্য যে, মাজার ইসলাম বা শরিয়তের কোনো অংশ নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি এ নিয়ে বেশ তর্ক বিতর্ক চলছে; তাই এ বিষয়টি নিয়ে লেখার গরজ অনুভব করলাম। আমাদের দেশে হিন্দু অধ্যুষিত অনেক এলাকায় প্রকাশ্যে গরুর মাংশ বিক্রি হয়, এ নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলে না। পার্বত্যাঞ্চলে প্রকাশ্যে শুকুরের মাংস বা নাপ্পি বিক্রি হয়, এ নিয়ে সমাজে কোনো বিশৃঙ্খলা হতে আমরা দেখিনি। কারণ কারো খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা কারো খাদ্য রুচি নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনো অধিকার সমাজ বা রাষ্ট্র দেয় না; এটা যার যার রুচির বিষয়। এ জন্য এসব খাদ্য অনেকের পছন্দ না হলেও বা ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও তাদের কোনো কিছু বলার থাকে না, বা কেউ কিছু বলেও না; মূলত: এটাই যথার্থ।
কিছুদিন আগে যখন হিন্দুদের কয়েকটি মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমরা সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি, কথা বলেছি এবং তা প্রতিহত করার জন্য সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। কারণ মন্দির বা আশ্রম হিন্দুদের উপাসনালয়, ইসলাম প্রতিটি মানুষকে তার বিবেক দিয়ে ধর্ম মেনে নেওয়ার স্বাধীনতা দেয় এবং মানুষ হিসেবে সে আল্লাহর হুকুম মেনে না চললে আখেরাতে বা শেষ বিচারের দিন তার শাস্তির হুশিয়ারি দেয়, কিন্তু দ্বীন এর ব্যপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে। মাজারগুলোও একার্থে কারো কারো জন্য ধর্ম চর্চা কেন্দ্র।
তবে মসজিদের সাথে এই উপাসনালয় বা ধর্মচর্চাকেন্দ্রের স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। মসজিদ নিছক ধর্মচর্চা কেন্দ্র বা এবাদতখানা নয়। মসজিদ হচ্ছে ইসলামী জীবন ধারার কেন্দ্রবিন্দু। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবো ইসলামের নবী (দঃ) তাঁর জীবদ্দশায় মসজিদ থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। হযরত আবু বকর এমন কি হযরত ওমর (রা:) এর শাসন আমল পর্যন্ত রাষ্ট্র-খেলাফত বা হুকুমাত পরিচালনা করা হতো মসজিদ থেকেই। তাই ইসলামী শরিয়তে মসজিদের মর্যাদা মহান তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বের সকল দেশেই মসজিদ রয়েছে; অনেক দেশে অন্য ধর্মের মানুষ সংখ্যায় বেশি হলেও তারা মসজিদ ভেঙ্গে দিতে পারে না। কারণ আইন এই অনুমতি দেয় না। তবে ভারতে বেশ কিছু মসজিদ নিয়ে তারা ইসলামের অনুসারীদের সাথে বে-ইনসাফি করেছে। এটা ভারতের নিচু মানসিকতার পরিচয় এবং বিশ্বজুড়েই তারা এ নিয়ে ধিকৃত হয়েছে, তারপরও তাদের লজ্জা নেই বলে, তারা মাঝে মাঝেই এমনটা করে যাচ্ছে।
এবার আসা যাক মাজার প্রসঙ্গে, বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এ দেশে সহ¯্রাধিক মাজার রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিতর্ক থাকলেও বেশিরভাগ মাজার কোনো না কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্বের সমাধি ঘিরে গড়ে উঠেছে। সেই ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সুফী, দরবেশ, পীর, আওলিয়া, বিভিন্ন নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে কোনো ভন্ড ব্যক্তিও তার কিছু তল্পী বাহকের সহায়তায় কিছু মাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এই বিষয়টিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এ কথাও সত্য যে, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের আশেপাশের দেশগুলোয় অনেক সময় মাজার কেন্দ্রিক ব্যবসা, প্রতারণা, মাদক ব্যবহার বা অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবহারেরও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু এক সময়ে হিন্দু অধ্যুষিত আমাদের এই উপমহাদেশে যাদের হাত ধরে ইসলামের প্রসার হয়েছিল, তাদের কবর বা সমাধিস্থল ঘিরেও অনেক মাজার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কারণ তারা যে সব জায়গায় বসে মানুষকে ইসলামী দীক্ষা দিতেন, সেগুলোকে খানকা/দরবার বলা হতো। তাদের মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁদের দাফন বা সমাহিত করা হয়। পরে তাঁর সমাধি ঘিরে গড়ে উঠে মাজার। সুফি বা ধর্মীয় প্রচারকদের কবর কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা মাজারে যারা মনষ্কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে মানত করে থাকেন, তাদের সেই বিশ্বাস: ভাংচুর বা লাঠির মাধ্যমে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পরিবর্তন করতে হবে জ্ঞান ও আলোর বিকাশের মাধ্যমে।
প্রনিধানযোগ্য যে, মাজার বা বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্বদের কবর ঘিরে এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার অবধারিত সম্ভাবনা ছিল বলেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কবর সমান করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামি শরিয়তে কারো কবর ঘিরে ঘর বানানো বা বিশেষ ব্যবস্থা করা নিষিদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সেই তাবে তাবেয়ীনদের যুগ থেকেই ধীরে ধীরে এই নির্দেশ অমান্য করার প্রচলন শুরু হয়। যার বিড়ম্বনা আমরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। এটা ইসলামিক স্কলারদের দুর্বলতা যে, তারা মানুষকে এ কথা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন- ‘ঐতিহ্য থাকলেই তা শরীয়ত নয়’। শরীয়তের মূল উৎস কোরআন হাদীস এবং তারপরে ইজমা কেয়াস। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ বা ইসলামী জ্ঞান কম, আমরা প্রায়ই লক্ষ করি, অনেক নামি-দামি ইসলামি ব্যক্তিত্ব তাদের বইয়ে কোরআন হাদীসের রেফারেন্স এর বদলে অমুক কিতাব, তমুক কিতাব উল্লেখ করে দলীল পেশ করেন। এই কেতাবী দলীল প্রকৃতপক্ষেই কোরআন হাদীসের কষ্টিপাথরে উন্নীত কিনা, তা যাচাই করার সক্ষমতা তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। ফলে আমরা অমুক তমুক কিতাবের উদ্ধতি পড়তে পড়তে এক সময় সেটাকেই ইসলামী দলীল হিসাবে ধরে নিয়ে ফেলি।
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় সাত শ’ শতাব্দীর দিকে এই উপমহাদেশে ইসলামের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু ইসলামের মূল প্রসার শুরু হয় ১১ শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। সেই সময়ে একদিকে মোহাম্মদ ঘুরির (মুইজুদ্দীন মোহাম্মদ) যুদ্ধ বিজয়, অন্যদিকে মঈন উদ্দীন চিশতির (রহঃ) খানকার প্রভাব ইসলামী আদর্শের প্রচার ত্বরান্বিত করে। সেই থেকে ১৮শ’ শতাব্দীতে মুঘল সাম্যাজ্যের পতন পর্যন্ত তথা মোজাদ্দেদ ই আলফেসানী (রহঃ) পর্যন্ত এ দেশে সুফি দরবেশরাই ইসলাম প্রচার করেন। এর মাঝে ১২শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ১৪ শ’ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত খান জাহান আলী থেকে শুরু করে শাহ মাখদুম, শাহাজালাল, শাহ পরান (রহঃ) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য। যাদের এ দেশের মানুষ সুফী দরবেশ নামেই জেনে এসেছেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এবং ফরায়েজি আন্দোলন ইসলামের ইতিহাসে এক একটি উজ্জল অধ্যায়, এই আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ১৯শ’ শতকে ইংরেজরা যখন এক সাথে ১৩ হাজার আলেমকে ফাঁসি দিয়ে গাছে গাছে ঝুলিয়ে রাখেন। তারপর আলেমদের একটি বিরাট অংশ তাদের দ্বীন প্রচারের কাজ কানকা কেন্দ্রিক চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এটা বিস্তারিত আলোচনার বিষয়।
উপরে উল্লেখিত ইসলামী ব্যক্তিত্বগণের ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি তাদের তাদের উদারতা, মহত্ত্ব, মহানুভবতা এ দেশের মানুষকে করেছে মুগ্ধ। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষেরা দলে দলে ইসলাম এর পতাকাতলে আশ্রয় নিয়ে শান্তি আর সমৃদ্ধির সন্ধান পেয়েছিল। এই শায়েখদের অনেকের সিলসিলা অনুসরণ করেই এদেশে সুফিবাদের বিকাশ ঘটে। সুফিবাদ ইসলামী শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা সেটাও বিস্তারিত আলোচনার বিষয়; আমি এই কলেবরে বিষয়টি আলোচনা করতে চাই না।
তবে বাগদাদ, বোখারা, সমকখন্দ, তাসখন্ড, তাবরিয, ইস্পাহান, আস্তারাবাদ, সাবযাওয়ার, মিহনা, বলখ এবং গযনী ইত্যাদি নামগুলো আমাদের মুসলীম সমাজে বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে বার বার। খোঁজ নিলে দেখা যায়, এই নামগুলো সুফিবাদের সাথেই বেশি জড়িত। সুফি ইসলামের ইতিহাসে মাজারগুলি ইসলামের প্রচার এবং সামাজিক ঐক্য স্থাপনে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সাধারণ অর্থে সুফি তাদের বলা হয়ে থাকে যারা শান শওকতে জীবন যাপনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সুফিবাদের প্রবক্তরা বলে থাকেন, যারা সুফিবাদের অনুসরণ করতে চান তাদের প্রথমে শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী হতে হবে। শরীয়তের যাবতীয় বিধানের মধ্য দিয়ে সুফী তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অনুগত করেন। শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কেউ সুফী হতে পারবে না। শরীয়ত অনুসরণের পর আসে মারেফত, তারপর তরিক্কত এবং তাদের ভাষায় সর্বোচ্চ স্তর হাক্কিকত। যদিও আমরা ইতহাস অধ্যয়ন এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখি যে, অনেক স্বঘোষিত সুফী- শরীয়ত মানার কথাটি জোর দিয়ে বললেও তাদের আচার-আচরণ এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
আমার সাধারণ জ্ঞান থেকে একটি ব্যক্তিগত মত হলো যে, তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে যারা প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামে দীক্ষিত হন, তাদের পূর্বের ধর্ম ছিল হিন্দু ধর্ম। আর হিন্দু ধর্মে সন্যাসী, ব্রম্মচারী এবং বৈরাগী ধারাটি ব্যপকভাবে আকর্ষিত একটি বিষয় ছিল। হিন্দু সন্যাসীদের পরিভাষা- পরমাত্মা, পরম চেতনা, ব্রম্মচারীর বিপরীতে সেই সময়ে তারা অবচেতন মনে বা জ্ঞানত তরিকত, হাকিকত বা সুফিবাদকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। এই একই মানসিকতা থেকেই হিন্দু পন্ডিতদের অলৌকিক ক্ষমতার বিপরীতে মুসলীম সমাজে কেরামতির বিষয়টি ব্যাপক প্রাধান্য পায় এবং পীর আওলিয়াদের কেরামতির নামে আমাদের সমাজে এমন সব চিত্তাকর্ষক ও আজগুবি গল্পের বিকাশ ঘটে যে, বিজ্ঞান মনস্ক বর্তমান প্রজন্মের সামনে ইসলামী আক্কিদা হিসেবে পরিচিত এই মতবাদগুলিকে অযৌক্তিক হিসেবে উপস্থাপন করে। যদিও ‘কারামত’ বাদ দিলে ইসলামের কোনো অঙ্গহানি হয় না।
সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করলাম যে, পীর আওলিয়াদের সমাধি ঘিরে গড়ে ওঠা এদেশের মাজারগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। ইসলামী শরিয়তে মাজার না বানানোর নির্দেশ থাকলেও মুসলীম সংষ্কৃতিতে মাজার এমন অবধারিতভাবে ঢুকে গেছে যে, সেই সময়ের হক্কানী আলেমরাও এ থেকে মুসলমানদের বিরত রাখতে পারেননি। আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারে আসা হক্কানী পীর এবং দরবেশরা কেউই তাদের কবর ঘিরে মাজার গড়ে তুলতে নিজেরা উৎসাহিত করেননি। কিন্তু তাদের ভক্তরা নিজেদের উদ্যোগে এসব গড়ে তুলেছেন। অতপর এসব মাজার ঘিরে যখন ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকলো এবং একসময় অলিদের অনুকূলে নিয়ে আসা হাদিয়া তার তিরোধানের কারণে তার মাজারে জমা হতে থাকলো; এর পরিমাণ এক সময়ে লোভনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। জমে ওঠা এসব সম্পদ অনেক ক্ষেত্রে এতিমখানা বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে এসব সম্পদ লালসার স্বীকারে পরিণত হলো। আর এই ভোগবাদী মানসিকতা থেকে অন্য আরো অনেক মাজার প্রতিষ্ঠার ধারা তৈরী হলো। এক পর্যায়ে মুর্খ ভক্তদের আড্ডা বেড়ে গেলো এবং বিকাশ ঘটলো শরিয়ত বিরোধি কার্যকলাপের। তবে মনে রাখতে হবে যে, সব মাজার ঘিরে কিন্তু এই ধারা তৈরী হতে পারেনি। অনেক মাজার ঘিরে গড়ে ওঠা বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও বাংলাদেশে ইসলামের আলো ছড়ানোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশের অনেক মাজার-খানকা বা দরবার ঘিরে নানা আঙ্গিকে অনইসলামী কর্মকান্ড বা হারাম কাজ পরিচালিত হওয়ার উদাহারণ এবং প্রমাণ রয়েছে। সেটা মাজারের দোষ নয়, পরিচালনাকারীদের দোষ। কোনো মাজারে হারাম এবং অসামাজিক কাজ হলে তার জন্য দেশে ভিন্ন ভিন্ন আইন রয়েছে। আইনী কাঠামোর মাধ্যমেও তাদের সঠিক পথে আনা সম্ভব। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, এ দেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে সুফী দরবেশদের অবদান খাটো করে দেখার সামান্যতমও সুযোগ নেই। তাদের নাম ব্যবহার করে এখন যেভাবে বিভিন্ন বেদায়াত এবং হারাম কাজের প্রবর্তন করা হয়েছে, এর জন্য সেই হক্কানী আলেমরা দায়ী নন। তাদের মাজারের প্রভাব দেখে পরবর্তীতে তাদের তরিকার নামে যারা শরিয়ত বিরোধি কাজের প্রচলন করেছেন, তাদের স্বরূপ উন্মোচন করা এ দেশের আলেমদের দায়িত্ব। ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপক প্রচার এবং দাওয়াতি কাজের মাধ্যমেই এসব সংশোধন করতে হবে, আইন হাতে তুলে নিয়ে নয়। আমরাই প্রচার করি যারা আদর্শ দিয়ে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়, তারা শক্তি বা সংখ্যা গরিষ্ঠের অপব্যবহার করে।
আমি এ লেখার শুরুতে পণ্যের উদাহরণ এনেছিলাম। যারা বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করেন, তার বা তাদের পণ্য যদি দেশের আইনে অবৈধ ঘোষণা না করা হয়ে থাকে, তিনি যে কোনো পণ্যের ব্যবসা করতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি একটু খেয়াল করি, তবে দেখতে পাবো, এমন অনেক পণ্য রয়েছে, যা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম, কিন্তু দেশের আইনে তা নিষিদ্ধ না হওয়ায়, সেই হারাম পণ্য বিক্রির দায়ে কোনো নাগরিককে হেনস্তা করার আইনী অধিকার অন্য নাগরিকের নেই। সেই কারণেই এ ধরণের অনেক পণ্য/সেবা বাজারে বিক্রি হতে দেখেও আমরা দিব্যি মেনে নিচ্ছি। কারণ এ জন্য দায়ী দেশের আইন, যতক্ষণ এ বিষয়ে আইন প্রণেতাদের মাঝে চেতনা সৃষ্টি করা না যাবে, ততক্ষণ এ ভাবে মেনে নেওয়াটা বৈধ। উদাহরণ স্বরূপ সুদি ব্যাংকের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। পাশাপাশি এমন কিছু পণ্য রয়েছে, যে পণ্যগুলো প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রি করা বেআইনী, ক্ষেত্র বিশেষে এমন পণ্যও আমরা প্রকাশ্যে বিক্রি হতে দেখি, কিন্তু নিজেরা কিছু করি না, কারণ আইন হাতে তুলে নেওয়া যায় না। এ বিষয়ে অনেকে কর্তাদের গুষ্টি উদ্ধার করেন, কিন্তু কখনও প্রত্যক্ষভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ডেকে নিয়ে হাতেনাতে ধরিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেন না।
মাজারগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা জরুরী। কোনো মাজারে শরীয়ত বিরোধি কিছু হতে দেখলে, তার বিপরীতে জনমত গড়ে তোলাটাই হবে প্রথম পদক্ষেপ। অত:পর সমাজ বিরোধি কোনো কাজ হতে দেখলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইনী প্রতিকার নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ঢালাওভাবে মাজারের বিরুদ্ধে নানা কথা ছড়ানো যেমন উচিৎ নয়, তেমনি যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মাজার ভাঙ্গার চেষ্টা করছে তাদের সহযোগী হওয়াও উচিৎ নয়। বরং উচিত তাদের নিবৃত্ত করা।